‘সকালে যেহানে রান্না করে খালাম, দুপুরে গেল নদীর প্যাটে’

Looks like you've blocked notifications!
নড়াইলে লোহাগড়া উপজেলার তেতুলিয়া গ্রামে মধুমতি নদীর ভাঙনে ঘবাড়ি সরিয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন হামিদা বেগম। ছবি : এনটিভি

‘সকালে যেহানে রান্না করে খালাম (খেলাম), দুপুরে গেল নদীর প্যাটে। অবস্থা বেগতিক দেহে (দেখে) রাত ১২টার দিকে নিজেরাই ঘর ভাঙা শুরু করলাম।’ -কথাগুলো বলছিলেন নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার চরবকজুড়ি গ্রামে মধুমতি নদীর ভাঙনে নিঃস্ব গোলজান বেগম (৫৪)।

নদীভাঙন নিয়ে গোলজান বেগম আরো বলেন, ‘এই ভাঙনে ছটি নারকেল গাছ, ২০টি আম, ৩০টি কাঁঠাল, ১৫০টি সুপারি ও ৩০০টি মেহগনি গাছসহ সবকিছু নদীর মধ্যে চলে গেছে। আর বসতভিটার ৪৫ শতক জমিও এহন (এখন) নদীর প্যাটে।’

আগে গোলজানদের বাড়ি ছিল লোহাগড়ার তেঁতুলিয়া গ্রামে। কিন্তু গ্রামটি নদীতে বিলীন হওয়ায় চরবকজুড়িতে এসে বাড়ি করেন তিনি। সেখানেও ভাঙনের কবলে এখন নিঃস্ব তাঁদের পরিবার।

এভাবেই মধুমতি নদীর ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে তেঁতুলিয়া গ্রাম। গত ১০ আগস্ট গ্রামটির শেষ বাড়িটিও মধুমতি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। গ্রামটি এখন জেলার মানচিত্রে থাকলেও আর দৃশ্যমান নেই। একই সঙ্গে চরবকজুড়ি ও কামঠানা গ্রামও বিলীনের পথে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ দিনের মধ্যে নদীগর্ভে চলে গেছে এ এলাকার ৩০টি বসতভিটা, বাড়িঘর ও বহু গাছপালা। এ ছাড়া প্রায় দুই বছর আগে নদীতে বিলীন হয়েছে তেঁতুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এ ছাড়া পাঁচ বছর আগে তেঁতুলিয়ার দুটি কবরস্থান ও ১০ বছর আগে তেঁতুলিয়ার একমাত্র মসজিদটিও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তবু ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

লোহাগড়া উপজেলার লোহাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ৬ নম্বর ওয়ার্ডে তেঁতুলিয়া গ্রামটি। ওই ওয়ার্ডের সদস্য চান মিয়া মোল্লা জানান, নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তেঁতুলিয়া গ্রামে ভোটার সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০০ জন। ২০১৬ সালের ইউপি নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ছিল ৪৫০ জন। এই ভোটারের মধ্যেও বেশির ভাগ ভাড়া থাকেন জেলা ও উপজেলা সদরসহ বিভিন্ন এলাকায়। সর্বশেষ তেঁতুলিয়া গ্রামে নান্নু মোল্লাদের বাড়িতে তিনটি পরিবারে ভোটার সংখ্যা ছিল ১৯ জন। গত ১০ আগস্ট মধুমতি নদীর ভাঙনে নান্নুদের বাড়িটিও শেষ রক্ষা হয়নি।

চান মিয়া মোল্লা আরো জানান, গত ১০ বছরে তেঁতুলিয়া গ্রামের ৪০০ পরিবার নদীভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়েছে। এ ছাড়া কামঠানা, চরবকজুড়ি ও ছাগলছিড়া গ্রামের প্রায় ৫০০ পরিবার মধুমতি নদীর ভাঙনে নিঃস্ব হয়ে অন্যত্র চলে গেছে। অনেক পরিবার সাতবার পর্যন্ত ঘরবাড়ি সরিয়েও রক্ষা পায়নি, গ্রাস করেছে মধুমতি নদী। তবু পাউবো কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ভাঙনরোধে এই এলাকায় এক ইঞ্চি কাজও করেনি।

তেঁতুলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শওকত হোসেন বলেন, ২০১৫ সালের আগস্টে বিদ্যালয়টি নদীগর্ভে চলে যায়। এরপর কামঠানা এলাকায় টিনের ছোট একটি ঘরে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। জোয়ারের সময় শ্রেণিকক্ষেও পানি উঠছে। ভাঙন প্রতিরোধে এখনই ব্যবস্থা না নিলে বর্তমানে যেখানে ক্লাস নেওয়া হচ্ছে, সেটিও ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বর্তমানে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী সংখ্যা ৯০ জন। অথচ দুই বছর আগেও দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল।

ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সদস্য নারায়ণ বিশ্বাস বলেন, এ এলাকায় বন্যা নেই। তবে, ভাঙনের কারণে শত শত মানুষকে যেখানে-সেখানে থাকতে হচ্ছে। তেঁতুলিয়া বিলীন হওয়ার পর চরবকজুড়ি ও কামঠানা গ্রাম ভাঙছে। বলা যায়, সবাই সর্বহারা হচ্ছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, তেঁতুলিয়া  গ্রামে নান্নু মোল্লার বাড়ির অর্ধেকের বেশি মধুমতি নদীগর্ভে চলে গেছে। টিনের ঘরগুলো খুলে নিয়ে গেছেন তাঁরা। ফাঁকা জায়গায় পড়ে আছে ধানের গোলা, মাইঠ (ধান বা শস্য রাখার মাটির পাত্র বিশেষ), ভাঙাচোরা আসবাবপত্রসহ গাছপালা। আর খুপড়ি রান্নাঘরটি দাঁড়িয়ে আছে বসতভিটার এক কোণে।

ওই বাড়ির গৃহকর্ত্রী হামিদা বেগম বলেন, ‘চুরি করে নিলেও ঘরবাড়ি থাহে, আগুনে পুড়লেও পোতা (ভিটেমাটি) থাহে। কিন্তু নদীতে ভাঙলে কিছুই থাহে না। নদীর কাজ নদী করে যাচ্ছে, দিনরাত ভাঙে যাচ্ছে। ঠেকানোর কোনো ব্যবস্থা নাই।’

হামিদা বেগম জানান, নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারানোর ভয় ও চিন্তায় তাঁর স্বামী গত কোরবানির ঈদের এক সপ্তাহ পর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তাঁদের সংসারে দুই ছেলে ও চার মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন তাঁদের থাকার জায়গাটুকুও নেই। আপাতত বাগানের মধ্যে ঘর উঠিয়ে কোনোভাবে থাকার ব্যবস্থা করেছেন।

নান্নু মোল্লার স্ত্রী মাছুমা বেগম বলেন, ‘নদীভাঙনে সবকিছু হারিয়ে আমার দেড় বছরের শিশুকে নিয়ে রোদ, বৃষ্টিতে অনেক কষ্টে আছি। আমরা কিছু চাই না, সরকার আমাদের নদীভাঙন ঠেকিয়ে দিক, একটু মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করে দিক।’

কামঠানা গ্রামের হামিদুল শেখ জানান, তিনবার নদীভাঙনে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকবার তাদের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো কাজ হয়নি। এখন পরের বাড়িতে কৃষিকাজ করেন তাঁরা।

তেঁতুলিয়া গ্রামের মগরেব মোল্লা বলেন, ‘আমার বাড়ি সাতবার ভেঙে গেছে। আমাদের ঈদগাহ পর্যন্ত ভেঙে গেছে। এবার কোথায় ঈদ নামাজ পড়ব, কী করব? এবার এলাকাবাসীর মনে ঈদ-আনন্দ নেই।’

মমরেজ মোল্লা জানান, নদীভাঙনে ঘরবাড়ি, জমিজমা সব হারিয়ে তেঁতুলিয়া  ও কামঠানা গ্রামের শত শত মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন। বেশির ভাগ এখন অনেক জমিতে কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এভাবে ২০ বছর নদী ভাঙলেও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

তোরাপ মোল্লা বলেন, ‘পাঁচবার বাড়িঘর সরানো হয়েছে। খুব অসহায় অবস্থায় আছি। এ ছাড়া আমাদের মসজিদ ও কবরস্থান নদীগর্ভে চলে গেছে। সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি, পাথর দিয়ে নদীটা যেন বেঁধে দেয়।’

চরবকজুড়ি গ্রামের জাহানারা বেগম বলেন, ‘নদীভাঙনে সব হারিয়ে এখন পরের জায়গায় বসবাস করি।’

ওই গ্রামের গৃহবধূ আসমা আক্তার সাথী জানান, তিনদিনে তাদের ৬০ শতক জমি নদীতে চলে গেছে। এ ছাড়া তালগাছ, দশটি নারিকেল গাছ, দুটি বাঁশঝাড় ও ৩০০ মেহগনি গাছের অর্ধেক নদীতে বিলীন হয়েছে। গত পাঁচদিনে নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে সেখানে। আর ছয় মাস আগে বাড়িঘর সরিয়ে অন্যত্র নেওয়া হয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পাশাপাশি এ এলাকার মানুষকে পুনর্বাসন, আর্থিক ও খাদ্য সহযোগিতা করা হয়নি।

চরবকজুড়ি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, নদীভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা এই এলাকার কয়েকটি পরিবার গত ১৯ আগস্ট তাদের টিনের ঘর খুলে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। কেউ খুলছে চালা, কেউ বেড়া, কেউ বা ঘর থেকে বের করছে আসবাবপত্র। বাড়ির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার জন্য মোবাইল ফোনে অনুরোধ করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। এ ছাড়া বিভিন্ন আকারের মেহগনি গাছগুলো কেটে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

ওই এলাকার বেগম বিবি বলেন, ‘নদীভাঙনের কারণে বসতঘর ভেঙে এনে পরের জায়গার ওপর রাখছি। এই অবস্থার মধ্যে অসুস্থ স্বামী ও প্রতিবন্ধী মেয়েকে নিয়ে কী যে কষ্টে আছি। সংসারে আয় করার মতো তেমন কেউ নেই। এখন শেষ সম্বল ভিটেমাটিটুকুও শেষ হয়ে গেল।’

লোহাগড়া ইউপির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মান্টু সিকদার জানান, ছাগলছিঁড়া-আমডাঙ্গা-চরবকজুড়ি থেকে লোহাগড়া উপজেলা সদরে যাতায়াতের কাচা রাস্তার প্রায় এক কিলোমিটার অংশ এখন মধুমতি নদীতে হারিয়ে গেছে। এ ছাড়া ভাঙনের তীব্রতায় এলাকার বিদ্যুৎ ও ডিশ সংযোগও খুলে ফেলেছেন ভুক্তভোগীরা। এ পরিস্থিতিতে নিদারুণ কষ্ট ও ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন সবাই।

লোহাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নজরুল সিকদার বলেন, ‘আমার নির্বাচিত এলাকার মধ্যে ‘তেঁতুলিয়া’ ওয়ার্ড মানচিত্রে থাকলেও দৃশ্যমান নেই। এখানে কোনো জনবসতি থাকার মতো অবস্থা নেই। নদীভাঙনে সব শেষ হয়ে গেছে। বর্তমান সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে দেশে নদীশাসনে কাজ করলেও আমার এলাকায় কোনো কাজ হয়নি। ভাঙনরোধে দ্রুত কাজ না করলে তেঁতুলিয়ার পাশের গ্রাম ছাগলছিঁড়া, কামঠানা ও চরবকজুড়িও বিলীন হয়ে যেতে পারে। আশা করছি, প্রধানমন্ত্রী এ এলাকায় অসহায় মানুষের দুর্দশার কথা বিবেচনা করে ভাঙন প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা নেবেন।’

এ বিষয়ে পাউবোর নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, ‘সাংবাদিকদের মাধ্যমে খবর পেয়ে তেঁতুলিয়ার ভাঙনকবলিত অংশ পরিদর্শন করেছি। ওই এলাকায় ভাঙনের তীব্রতা দেখা দিয়েছে। এ জন্য কিছু ঘরবাড়ি সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয়েছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি। প্রয়োজনীয় বাজেট পেলে ভাঙন প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’