কক্সবাজারে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, ফের বন্যার শঙ্কা

গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে কক্সবাজার জেলায় থেমে থেমে ভারি বর্ষণ চলছে। বৃষ্টির তোড়ে জেলার মিঠাপানির পাঁচ নদীতে নেমেছে ঢল। এতে করে সাম্প্রতিক বন্যায় সৃষ্ট ভাঙন দিয়ে পানি ঢুকে প্লাবিত হচ্ছে জেলার নিম্নাঞ্চল। গ্রামের পর গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়ছে মানুষ। তারা ফের বন্যার শঙ্কা করছে।
বৃষ্টি ও ঢলের পানি রাস্তার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার অনেক সড়কে বন্ধ রয়েছে যান চলাচল। জেলার মাতামুহুরি, বাঁকখালী ও ঈদগাঁও ফুলেশ্বরী নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অনেক এলাকায় সড়ক ভেঙে বিচ্ছিন্ন রয়েছে সব ধরনের যোগাযোগ। ব্যাহত হচ্ছে আমন চাষাবাদ।
কক্সবাজার আবহাওয়া কার্যালয় জানায়, শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে শনিবার বেলা ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ভারি বর্ষণ ও বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকায় কক্সবাজার উপকূলকে তিন নম্বর সতর্কসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
কক্সবাজার জেলায় ভারি বৃষ্টিপাত আরো কয়েকদিন স্থায়ী হতে পারে উল্লেখ করে আবহাওয়া কার্যালয় সবাইকে সতর্ক অবস্থায় থাকতে ও পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন শনিবার সন্ধ্যায় এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ভাঙনের কবলে পড়া নদীতীর মেরামতের উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো তা সম্পন্ন হয়ে ওঠেনি। আবারও ভারি বৃষ্টিপাত চলায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার খবর আসছে। জনদুর্ভোগ সম্পর্কে খোঁজ রাখতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে বন্যায় কক্সবাজারের সদর, চকরিয়া, পেকুয়া ও রামু উপজেলায় লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতির মুখে পড়ে। এ সময় জেলার প্রায় ২১ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে জানায় জেলা প্রশাসন।
জেলা সদরের কলাতলীর ব্যবসায়ী হাবিব মিজবাহ ও মাওলানা জামাল উদ্দিন জানান, টানা বর্ষণে পানি জমে কক্সবাজার শহরের হোটেল-মোটেল জোন, কলাতলী, লারপাড়া, চাঁদেরপাড়া, হাজিপাড়া, পেশকারপাড়া, এসএম পাড়া, বিডিআর ক্যাম্প, পেতা সওদাগর পাড়া, রুমালিয়ার ছড়া, চরপাড়া, সমিতিপাড়াসহ শহরের আশপাশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে।
বার্মিজ মার্কেট এলাকার দোকানি শফিউল আলম ও ইকবাল বাহার জানান, শহরে টানা ১০ থেকে ১৫ মিনিট বৃষ্টি হলে বাজারঘাটা এলাকার সড়ক দুই থেকে তিন ফুট পানিতে ডুবে থাকছে। রিকশা ছাড়া অন্য কোনো যানবাহন চলাচল কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। বড়বাজার, বার্মিজ মার্কেট ও বাজার হাটা এলাকার শতাধিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জলমগ্ন থাকায় খোলা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকে নষ্ট হচ্ছে মালামাল।
ব্যবসায়ীরা আরো জানান, একটু বৃষ্টি হলেই এ সড়কের পাশাপাশি হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি চলাচল করছে বৌদ্ধমন্দির সড়ক, গোলদিঘির পাড়, অ্যাডভোকেট সালামত উল্লাহ, বড়বাজার এলাকা ও পেশকারপাড়ায়।
রামু উপজেলার চেয়ারম্যান রিয়াযুল আলম জানান, গত দুদিনের বৃষ্টিপাতে খুনিয়াপালং ইউনিয়ন ছাড়া ফতেখার কুল, কাউয়া কূপ, কচ্ছপিয়া, গর্জনিয়া, চাকমার কুল, জোয়ারিয়া নালা ও দক্ষিণ মিঠাছড়ি ইউনিয়নের প্রায় প্রতিটি এলাকা আবারও প্লাবিত হচ্ছে।
গত বন্যায় বাঁকখালী নদীর তীর রাজারকুল, অফিসের চর, মুক্তার কুল, পিএমখালীসহ ভাঙনের কবলে পড়া একাধিক স্থান মেরামত করা সম্ভব না হওয়ায় সেসব স্থান দিয়ে সহজে পানি ঢুকে গ্রামের পর গ্রাম আবারও পানিবন্দি হয়ে পড়ছে।
রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আরো জানান, রামু-নাইক্ষংছড়ি সড়কের কাউয়ার কূপ গাছুয়াপাড়া ফরেস্ট অফিস এলাকায় রাস্তার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় বন্ধ রয়েছে সড়ক যোগাযোগ।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আলম জানান, ভারি বর্ষণে মাতামুহুরী নদীর পানি আবারও বাড়ছে। বৃষ্টির পানি জমছে সমতল এলাকাতেও। নদীর ভঙ্গুর বাঁধ দিয়ে পানি প্রবেশ করায় বরইতলী, হারবাং, লইক্ষ্যারচর, কৈয়ারবিল, কাকারা, পৌরসভার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল ধীরে ধীরে প্লাবনের শিকার হচ্ছে। ক্রমে পানিবন্দি হচ্ছে পার্শ্ববর্তী উপজেলা পেকুয়াসহ বিশাল এলাকা।
অপরদিকে, মেরামতকাজ শুরু হওয়ার চারদিনের ব্যবধানে ফের ভারি বর্ষণে মাতামুহুরী নদীর পানির প্রবল চাপে ভেঙে গেছে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার চিরিঙ্গা ইউনিয়নের পালাকাটা জেটি (রাবার ড্যাম) সড়কের আড়াইশ মিটার বেড়িবাঁধ।
এতে শনিবার দুপুর থেকে নদীর পানির প্রবল চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে নদীর পানি।
চকরিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সাহেদুল ইসলাম জানিয়েছেন, মেরামত করা বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। বেড়িবাঁধের ওই অংশ দিয়ে নদীর পানি অনায়াসে ঢুকে পড়ায় গ্রামের লোকজন পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
টানা বর্ষণে পাহাড়ি ঢলে মহেশখালীর গোরক ঘাটা-জনতা বাজার সড়কের হোয়ানক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে ও শাপলাপুর এলাকায় এবং ছনখোলাপাড়ায় প্রধান সড়কের তিনটি স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। এতে বন্ধ হয়ে গেছে সড়ক যোগাযোগ। আটকা পড়েছে পান ও মালবাহী অসংখ্য গাড়ি।
সদরের পোকখালীর আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া পোকখালী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক মাওলানা মুহাম্মদ আজিজ জানান, সাম্প্রতিক বন্যায় ঈদগাঁও নদীর ছমিউদ্দিন পাড়ায় ভাঙনের কবলে পড়া বাঁধ দিয়ে অনবরত পানি ঢুকে বিস্তীর্ণ এলাকা ধীরে ধীরে পানিবন্দি হয়ে পড়ছে। অনেক সড়ক উপসড়ক পানিতে ডুবে থাকায় বিঘ্নিত হচ্ছে জন ও যান চলাচল।
এ ছাড়া ভারি বর্ষণে জেলার আমন চাষাবাদ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। শত শত একর আমন বীজতলা প্লাবিত হওয়ায় কৃষকরা চারা উত্তোলন করতে পারছেন না। তাঁরা জানান, আমন বীজতলা পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় চারা পচে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।