বনরুটি আর ‘দুয়া বাতে’র কথা
১৯৯১ সাল। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি। সংবাদপত্র পড়ার নেশা ওই বয়স থেকেই। বাসায় পুরোনো আমলের নিউজপ্রিন্টের ইত্তেফাক আসত। বেশ মনে আছে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ইত্তেফাকের পাতার মাধ্যমেই প্রথম জেনেছি। মিয়ানমারের তখন নাম ছিল বার্মা। বাবা বার্মা আর বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে জানান। কিছুটা বড় ক্লাসে উঠার পর একটা বইয়ের নাম জানতে পারি, ‘আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য।’ ড. এনামুল হক ও আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের লেখা একটা বিখ্যাত বই। বাবার কাছেই জানলাম আরাকান রাজ্য আর বাংলা ভাষার সঙ্গে ওই রাজ্যের সম্পর্ক। ‘আরাকান’ শব্দটির সঙ্গে এভাবেই আমার পরিচয়।
১৯৯১ সালে নির্যাতন আর প্রাণ বাঁচাতেই বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল রোহিঙ্গারা। ২০১৭ সালে এসে আবারও সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলো ওই জনগোষ্ঠী। এবার তার তীব্রতা আরো বেশি। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে ঢাকার অফিসে বসে থেকে শুধু কাজ করার ইচ্ছে করছিল না। বিশ্বব্যাপী যে পরিস্থিতি তুমুল আলোচনার বিষয় তা স্বচক্ষে দেখে বিষয়টা বোঝার খুব আগ্রহ ছিল। আমার সেই আগ্রহ আর আবদারে সাড়া দেন এনটিভি অনলাইনের প্রধান জুয়েল ভাই। নিজেই ব্যবস্থা করে দেন টেকনাফে যাওয়ার।
৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে রওনা দেই। সঙ্গে ইংরেজি বিভাগের শেখ খলিলুর রহমান সোহেল ও ফটোসাংবাদিক মোহাম্মদ ইব্রাহিম। ততক্ষণে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে স্রোতের মতো আসছে রোহিঙ্গারা। গত ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হয় তাদের স্বদেশ ত্যাগ।
মেরিন ড্রাইভে বিষাদ
কক্সবাজারের কলাতলী থেকে দারুন এক সড়ক চলে গেছে টেকনাফের দিকে। ওই সড়ক দেখতেই সেখানে বেড়াতে আসে অনেক মানুষ। একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে সাগর। ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিল আমাদের গাড়ি। গন্তব্য টেকনাফ। ইনানি বিচ পার হতেই হৈ চৈ শোনা গেল। দুইপাশে মানুষজন বসে আছে। কারো হাতে ব্যাগ, নারীদের কোলে শিশু। কোনো গাড়ি এসে থামলেই শিশুরা গাড়ি ঘিরে ধরছে। ওরা খাবার চায়। জানলাম এলাকাটির নাম শাপলাপুর। মিয়ানমার থেকে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে অনেক রোহিঙ্গা শাপলাপুরে সৈকতে নামে। পরে ওই সড়কে ঠাঁই নেয়। এখানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলি। তাঁরা জানান তাঁদের দুর্দশার কথা। আরিফ নামে এক যুবক এখানে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আরিফ নিজে একজন রোহিঙ্গা। ১৯৯১ সালে তিনি মা-বাবার সঙ্গে সাগর পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার চলে আসেন। আর যাওয়া হয়নি। এখানে এসেছেন রোহিঙ্গাদের দেখতে। আপনার কোনো স্বজন আছে? বললেন, ‘থাকলেও লাভ নেই ভাই। সরকার বলসে উনাদের বাসায় থাকতে দিতে পারবা না। ওরা ক্যাম্পে থাকবে।’
কুতুপালং আর বালুখালীর জীবন
সরু সড়কে একটা ট্রাক এসে থামল। মুহূর্তে ট্রাকের চারপাশে শতাধিক মানুষ। শিশু আছে, আছে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাও। ট্রাক থেকে ছুঁড়ে মারা হচ্ছে প্যাকেট। প্যাকেটে দুটি পাউরুটি (লোকমুখে বনরুটি নামে পরিচিত), একটা বিস্কুটের প্যাকেট, একটা কলা। সরু সড়কে বাস, ট্রাক থেকে নিজেদের কোনো মতে বাঁচিয়ে রোহিঙ্গা শিশু আর নারী-পুরুষ বনরুটির প্যাকেট নিতে ব্যস্ত। কাড়াকাড়িতে এক লোকের একটা বনরুটি পড়ে গেলে কাদামাটিতে। লোকটা দ্রুত ওই কাদামাটি থেকেই বনরুটিটা তুলে নিল। ময়লা লুঙ্গি দিয়ে মুছে নিল বনরুটিটা।
আট বছরের একটা শিশু। তার কোলে দুই বছরের আরেকটা শিশু। ছোট শিশুটা কাঁদছে। বড় শিশুটা ভিড় ঠেলে ট্রাকের কাছাকাছি যেতে পারছে না। যেতে পারলে হয়তো একটা বনরুটির ব্যবস্থা করতে পারত। ছোট শিশুটি বেশ কাঁদছিল। সড়কের পাশের মাঠে অনেক খানাখন্দ। কাঁদাপানি জমে আছে। নিজের ছোট ভাইয়ের মুখ হাত ওই কাদামাটির পানিতে ধুয়ে দিল। একটু যেন আরাম লাগছে শিশুটির!
একপাশে একজন যুবক তার বাচ্চাকে নিয়ে বসে আছেন। বললেন, ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় মিয়ানমারের সেনারা। ঘরে যে ছোট শিশুটি ছিল তা মনে পড়ে বাবা আরিফের। দ্রুত গিয়ে শিশুকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। শিশুটির পিঠে বিশাল পোড়াদাগ। তীব্র রোদে বাবার কোলে বসে খাবার চাইছে সে।
এক সপ্তাহের মধ্যই কুতুপালং আর বালুখালী লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। ওখানে রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প করা হয়েছে।
শাহ পরীর দ্বীপের দুঃখ
নাফ নদীর তীরেই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ক্যাম্প। নাফের ওই পাড়েই মিয়ানমার। এ নদী পাড় হয়ে রোহিঙ্গারা আসে। ওই নদীতেই ডুবে যায় রোহিঙ্গাদের নৌকা। জেটির দিকে যেতেই একজন বললেন, ডান দিকে বিজিবির ক্যাম্পের দিকে যান। ওখানে আপনাদের জন্য সংবাদ আছে। জেটি এলাকাতেই গরুর হাট বসেছে। এসব গরু এসেছে মিয়ানমার থেকে, নাফ নদীর পার হয় গরু এপারে আসে ট্রলারে। আর রোহিঙ্গা মানুষ এ পাড়ে আনা হয় সাধারণ নৌকায়।
কিছুদূর হাঁটতেই বিজিবি ক্যাম্প। একটু পরেই সৈকতে চোখে পড়ল এক নারীর লাশ উল্টে আছে। বোরকাটা এখনো শরীরের সঙ্গে লাগানো। কানে দুলও আছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ফজলুল হক জানালেন, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে একদমই ঘুমাতে পারিনি। গভীর রাতে নৌকা আসে। নৌকা ডুবেও যায় রাতে। মধ্যরাতে ডাক পড়ে তাঁর। স্থানীয় বাসিন্দারা এসে জানান, মেম্বার সাব নৌকা ডুবে গেছে। তীরে আসছে লাশ। ফজলুল হকের দায়িত্ব পড়ে মারা যাওয়া রোহিঙ্গাদের লাশ দাফনের।
আমাদের সঙ্গে কথা বলেন আর নাফ নদীর দিকে তাকিয়ে থাকেন ফজলুল হক। মাথার চুল এলোমেলো। শার্টের বুক পকেটে রাখা মোবাইল ফোনটা একটু পর পর বেজে উঠে। কথা বলেন। একটু হেসে ক্লান্তি দূর করার চেষ্টা করেন। আমাদের বলেন, ‘ভাই, গত ২১ দিনে ৪৭টা লাশ দাফন দিয়েছি আমি নিজে। এর মধ্যে আছে শিশুও। এসব দেখতে দেখতে আর ভালো লাগে না। আমিও তো মানুষ।’
ফজলুল হকের কথার জবাব নেই আমাদের কাছে। তিনি আবার আমাদের বলেন, ‘ভাই আপনারা তো সাংবাদিক। ঢাকা থেকে আসছেন। আপনাদের কাছে তো অনেক খবর। এ সমস্যার সমাধান হবে? বিশ্বনেতারা কিছু ভাবছেন? ফজলুল হকের কথার জবাব নেই আমাদের কাছে। ফজলুল হক জবাবের অপেক্ষা করলেন না। মসজিদ থেকে খাটিয়া এসে গেছে। সেখানে তোলা হলো দ্বীপে ভেসে আসা ৪৭ নম্বর লাশ।
‘দুয়া বাতে’র গল্প
যেসব এলাকা দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, তার একটি বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম পয়েন্ট। পাহাড়ের পথ বেয়ে হেঁটেই বাংলাদেশে প্রবেশ করা যায়। কিন্তু ওই সীমান্তটিই ভয়ানক। মিয়ানমারের সেনারা সেখানে পুঁতে রেখেছে মাইন। সকালে গিয়ে হাজির হই ওই এলাকায়। বিজিবির এক সদস্য পাহারা দিচ্ছেন। জানালেন, সামনেই নো ম্যানস ল্যান্ড। চোখে পড়ল সরু একটি খাল। আসলে এটি তমব্রু নদী। ওই নদীর তীর ঘেঁষেই পলিথিনের নিচে বাস করছে প্রায় এক হাজার ২০০ পরিবার। তীরে দাঁড়ালেই চোখে পড়ছে কাঁটাতারের বেড়া। আমাদের দেখে অনেকেই হাজির হলেন। শিশুরা আনন্দে মেতে উঠেছে তমব্রু নদীর হাঁটুজলে।
সবার আগে কথা হলো ‘মাঝি’র সঙ্গে। মাঝি মানে মাতবর। প্রত্যেক রোহিঙ্গা ক্যাম্পেই মাঝি আছে। নিজেরাই নিজেদের মধ্য থেকে মাঝি নির্বাচন করে নেয়। মাঝির কাজ সমন্বয় করা। নিজেদের দাবির কথা তুলে ধরা। কর্তৃপক্ষ যা জানাচ্ছে, তা রোহিঙ্গাদের জানানো। মাঝিরা সব একই কথা বলছিলেন। যা গত কয়েকদিন ধরে শুনছিলাম। নতুন কিছু পাচ্ছিলাম না। এমন সময় ভিড়ের মধ্যে দেখি এক লোক কথা বলতে চায় আমাদের সঙ্গে।
তাঁর নাম কবির। তাঁর পাঁচ সন্তানের খোঁজ নেই। এক সন্তানের খোঁজ পেয়েছেন। জানতে পেরেছেন ওই সন্তান নিহত হয়েছে। কবিরের পরনের জামাটা ময়লা। শীর্ণ শরীর নিয়ে কোনোমতে হাঁটাচলা করেন। কবির ভাত খেতে চান। বাড়ি ছাড়ার পর থেকে ভাত খাননি তিনি। রোহিঙ্গাদের অন্যান্য ক্যাম্পে ত্রাণ পৌঁছালেও দুর্গম এলাকা বলে এখানে ত্রাণ আসছিল না। কবির আকুতি করতে থাকেন, ‘আতি ভুক লাইগসে। বাত না হাইদ্দে। আঁরে দুয়া বাত দাও।’
কবিরকে ধরেই প্রতিবেদনটা লিখি। যার শিরোনাম ‘আঁরে দুয়া বাত দাও’। সাংবাদিক হিসেবে আমি কেবল মানুষকে জানাতেই পারি। আর যে কিছু করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু জানানোর ক্ষমতাটাই বিশাল। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরই ঢাকা থেকে ফোন আসে একদল তরুণের। তাঁরা ত্রাণ নিয়ে আসবেন রোহিঙ্গাদের জন্য। যেহেতু ঘুমধুম শিবিরের অবস্থা খারাপ, এ কারণে যেতে চান সেখানে। পরের দিন শুনলাম, ঘুমধুমের ওই শিবিরে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে। সবাইকে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সাগর, পাহাড় পেছনে রেখে আমাদের গাড়ি রাজধানীর দিকে ফিরে চলে। কবির নিশ্চয়ই ভাত খেয়েছে। শিশুটি নিশ্চয়ই ব্যথা ভুলে আরামে ঘুমিয়েছে। নিশ্চয়ই ওরা একদিন নিজের দেশে, নিজের মাতৃভূমিতে ফিরে যাবে। ফিরে আসতে আসতে কেন জানি ছোটবেলায় বাবার কাছে শেখা সেই লাইনটা মনে পড়ে গেল, ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী’। হ্যাঁ, স্বর্গ তো নিজের মাতৃভূমিতেই হয়!