শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মরণে ৩০ বছর ধরে দুর্গোৎসব

Looks like you've blocked notifications!
পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পল্টু মোহন চৌধুরীর স্মরণে ৩০ বছর ধরে শহরের গোপালপুর মহল্লার ‘শহীদ পল্টু ক্লাব’ শারদীয় দুর্গোৎসব পালন করছে। ছবি : এনটিভি

পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পল্টু মোহন চৌধুরীর স্মরণে ৩০ বছর ধরে একটি শারদীয় দুর্গোৎসব পালিত হচ্ছে। শহরের গোপালপুর মহল্লার ‘শহীদ পল্টু ক্লাব’ এত বছর ধরে পূজাটির আয়োজন করে আসছে।

এই পল্টু ক্লাবেরই এক সদস্য গোপাল স্যানাল এখন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। প্রতিবারের মতো এবারও পূজায় এসেছেন দেশে। আর দেশে এসেই যোগ দিয়েছেন ৩০ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ আয়োজনে।

গোপাল স্যানাল এনটিভি অনলাইনকে জানালেন, পাবনা শহরের গোপালপুর মহল্লারই ছেলে ছিলেন পল্টু মোহন চৌধুরী। উদ্যমী এই তরুণ ছিলেন মহল্লার মধ্যমণি। সাংস্কৃতিক আয়োজনসহ বিভিন্ন কাজে সবার অগ্রগামী। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর যোগ দিয়েছিলেন দেশমাতৃকার স্বাধীনতার লড়াইয়ে। অংশগ্রহণ করেছিলেন বেশ কয়েকটি যুদ্ধেও।

১৯৭১ সালে ১৪ অক্টোবর স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে রাজাকারদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন পল্টু।  ঢাকা পাবনা মহাসড়কের সাদুল্লাপুর ইউনিয়নের নন্দনপুর গ্রামের কবরস্থানের পাশে পল্টুসহ আরো দুই মুক্তিযোদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। হত্যার পর গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল তাঁদের লাশ।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এই শহীদের নাম প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন অনেকে। কিন্তু পল্টুর নিজের গোপালপুর মহল্লার কিছু উদ্যমী যুবক তাঁর স্মৃতিকে হারাতে দেননি। ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় শহীদ পল্টু ক্লাব। এরপর ১৯৮৭ সালে শহীদ পল্টু ক্লাবের আয়োজনে পালিত হয় শারদীয় দুর্গোৎসব। এর পর ১৯৯১ সাল থেকে একটানা চলছে শহীদ পল্টুর স্মরণে শারদীয় দুর্গা উৎসব।

গোপাল স্যানাল  আরো জানান, শহীদের নামে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবটি এখন স্থানসংকটে রয়েছে। তিনি বলেন, পল্টু ক্লাবের পূজা শুধু পূজা নয়, এটি সম্প্রীতির মেলবন্ধনের জায়গা। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবাই এসে পল্টু ক্লাবের উৎসবে যোগ দেয়। কিন্তু এ ক্লাবের পূজার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। আগের অবস্থান থেকে সরে এসে অনেক ছোট পরিসরে ঐতিহ্যবাহী এ ক্লাবটির পূজার আয়োজন চলছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

জেলার নাট্য সংগঠন ‘পাবনা ড্রামা সার্কেলে’র সভাপতি ফারুক হোসেন চৌধুরী বলেন, শারদীয় দুর্গাৎসবে পল্টু ক্লাব একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান। পাবনা জেলার মধ্যে এটি একটি ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। অসাম্প্রদায়িকতার একটি বড় নিদর্শন। এই পূজাকে ঘিরে মহল্লাটিতে একটি মিলনমেলা হয়। বহু ধর্মের মানুষ সেখানে যায়। যা সবাইকে অনুপ্রাণিত করে।

শহীদ পল্টুর ছোট বোন জোসনা অধিকারী এনটিভি অনলাইকে বলেন, ‘আমার ভাই মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হয়েছিলেন। তবে আমরা কখনো সরকারি কোনো সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করিনি। তবে আমার ভাইয়ের নামে একটি ক্লাব রয়েছে। ক্লাবটি প্রতিবছর শারদীয় দুর্গা উৎসব পালন করে থাকে। আমরা পরিবারের সবাইকে নিয়ে পূজা দেখতে যাই। বেশ ভালোই লাগে সবার মুখে আমার শহীদ ভাইয়ের কথা শুনতে।’

শহীদ পল্টু ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক গৌতম মজুমদার বলেন, আজ থেকে ৩০ বছর আগে শহীদ পল্টু ক্লাবের নামে পূজা করে আসছি। আগে এলাকায় বিভিন্ন মাঠঘাট ছিল। সেখানে খুব সহজেই পূজার আয়োজন করা যেত। কিন্তু এখন শহরে অনেক বহুতল ভবন গড়ে উঠায় স্থানসংকট দেখা দিয়েছে। অন্যের জায়গায় আর কতদিন পূজা করা যায়। বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারছি না আমরা। ফলে ইদানীং কিছু সমস্যা হচ্ছে। তবে যত সমস্যাই হোক শহীদ পল্টু ক্লাব এ পূজা চালিয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন গৌতম মজুমদার।

শহীদ পল্টু প্রসঙ্গে পাবনার বীর মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলাম জানালেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ পল্টু আমার ছোট ভাই মতিউর রহমান মতি ও আব্দুল মান্নান একসঙ্গে পাবনার দিকে আসছিলেন।  পথে তারা রাজাকারদের অস্ত্র কেড়ে নিলে একজন পালিয়ে গিয়ে অন্য রাজাকারদের খবর দেয়। পরে সদলবলে রাজাকার আলবদর আর পাকিস্তানি আর্মি মিলে এই দুই মুক্তিযোদ্ধাকে ঘেরাও করে নির্মমভাবে হত্যা করে।

বেবী ইসলাম আরো বলেন, আমরা সবাই ভুলে গেছি মুক্তিযোদ্ধা পল্টু ও মতির কথা। কিন্তু শহীদ পল্টু ক্লাব প্রতি বছর এই উৎসব করে আমাদের সেদিনের সেই ভয়াল স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।

এদিকে এ পূজার বিষয়ে পাবনার জেলা প্রশাসক রেখা রানী বালো বলেন, এবারে পাবনাতে  ৯টি উপজেলায় ৩১৯টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপিত হচ্ছে। এর মধ্যে পাবনায় সদর উপজেলায় ৫১টি মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। যার মধ্যে একটি ক্লাব মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের নামে প্রতিষ্ঠিত। তারা প্রতি বছর অনেক সাজসজ্জা করে উৎসব পালন করে থাকে। তবে ক্লাবটির জায়গার সংকটে পড়েছে বলে শুনছি। বিষয়টি আমার জানা ছিল না। পূজার পরে বিষয়টি নিয়ে ক্লাব কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে এর একটি  সমাধান করা যেতে পারে বলেও জানিয়েছেন পাবনার জেলা প্রশাসক।