‘সাজানো ছবি’র বিরুদ্ধে ‘সাজানো মামলা’!

Looks like you've blocked notifications!

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার জয়নগর গ্রামে গাছের সাথে রশি ও শিকল দিয়ে বেঁধে দুই শিশু নির্যাতনের ‘সাজানো ছবি’র বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে সেই মামলায় ছবি ‘বানানোর’ সাথে জড়িত দুই শিশুর বাবা এবং চাচা এই তিনজনের কাউকেই আসামি করা হয়নি।

উপরন্তু নিজ উদ্যোগে এ মামলার বাদী হয়েছেন ওই গ্রামের গাজী আনিসুর রহমান, যিনি ঘটনার শিশু নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় কারাগারে আট গোলাম মোস্তফার পরিবারেরও কেউ নন। ফলে মামলাটিও ছবিটির মতো ‘সাজানো’ কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

দুই শিশুকে গাছের সঙ্গে বেঁধে ‘সাজানো ছবি’ তৈরি করে সরকারের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করার অভিযোগে গত রোববার রাতে জয়নগর গ্রামের আনিছুর রহমান বাদী হয়ে তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তি আইনের ২০০৬ এর ৫৭ (১) ধারায় এ মামলা দায়ের করেন (মামলা নম্বর ৪২)।

মামলার আসামিরা হলেন উপজেলার বাদঘাটা গ্রামের কলেজ শিক্ষক ও স্থানীয় সাংবাদিক সামিউল মনির, গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা সাংবাদিক রবিউল ইসলাম, গোপালপুর গ্রামের আবদুর রশিদ ও জয়নগর গ্রামের ইউনুছ গাজী।

এর আগে গত নির্যাতনের অভিযোগ এনে ঘটনার এক সপ্তাহ পর ১৩ জুলাই শিশু আবু নাসিমের বাবা হামিদ তরফদার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে শ্যামনগর থানায় মামলা করেন। পরের দিন মামলার আসামি গোলাম মোস্তফাকে আদালত জেলহাজতে পাঠান। ওই মামলায় আসামি করা হয় মোস্তফার ছেলে গোলাম হোসেনকেও। তিনি এখনো পলাতক।

শুরু থেকেই শিশু নির্যাতনের ছবিটি নিয়ে পুলিশের সন্দেহ ছিল। পরে পুলিশ এর ‘রহস্য’ উদঘাটন করে জানায়, শিশুর ইয়াসিনের বাবা, চাচা ও এক সাংবাদিকের যোগসাজসে ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছবিটি বানানো’ হয়।

এ ঘটনার বিরুদ্ধে কারাগারে আটক গোলাম মোস্তফার স্ত্রী মাসুদা খাতুন মামলা করার কথা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি মামলা না করে স্বউদ্যোগে মামলার বাদী হন জয়নগর গ্রামের গাজী আনিসুর রহমান।

মামলার বাদী গাজী আনিসুর রহমান আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি শ্যামনগর থানায় গিয়ে ওসিকে বলি এর একটা প্রতিবাদ বা মামলা হওয়া উচিত। ওসি বলেন, এ ব্যাপারে যেকোনো ব্যক্তিই মামলা করতেই  পারেন। তবে তিনি ওই পরিবারের কাউকে বাদী করার কথা বলেন। তখন আমি আটক গোলাম মোস্তফার স্ত্রী মাসুদা ভাবীর সাথে কথা বলে মামলা করতে বলি। তিনি আসতে চেয়েও পরে আর আসেননি। এরপর তার সাথে আর যোগাযোগও করতে পারিনি। আমি নিজের জন্য একটি এবং মাসুদা ভাবীর জন্য আরেকটি মোট দুটি মামলার খাসড়া করি। কিন্তু ভাবী না আসায় আমি মামলাটি করি।’

মামলায় আবদুর রশীদ ও ইউনুস গাজীকে আসামি করার ব্যাপারে বাদী বলেন, ‘রশিদ গাইন শিশু ইয়াসিনের বাবা ইসমাইলের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠ। সেই ইসমাইলকে কুপরামর্শ দিয়ে ছবি তৈরি করেছে। সেই মূল নায়ক। তাছাড়া ইউনুস গাজীর সাথেও ইসমাইলের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এতে আমার ধারণা হয়েছে, তারা দুজনেই জড়িত।’ 

গাজী আনিসুর রহমান আরো বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতায় বুঝেছি, শিশু দুটির বাবাকে আসামি করা হলে তাদের আগের মামলা ( যেটি মোস্তফার বিরুদ্ধে করেছেন শিশুর বাবা আবদুল হামিদ) সেটা দুর্বল হয়ে যাবে।’

এ ব্যাপারে কোনো আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করেছেন কিনা জানতে চাইলে মামলার বাদী বলেন, ‘উকিল না হলেও আমার কিছু বন্ধুবান্ধব তো আছে। তারা আমাকে এই পরামর্শ দেন। তবে মামলা তদন্তকালে যাদের নাম আসবে তারা যেমন আসামি হবেন, আবার যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে না তারা বাদ যাবেন এটাই স্বাভাবিক।’

গাজী আনিসুর রহমান আরও বলেন, ‘এখনকার সময়ে মামলার বিপরীতে কাউন্টার মামলার চল রয়েছে। এ জন্য পুলিশ যাতে এমন কথা না বলতে পারে সেজন্যই শিশু দুটির বাবা জড়িত থাকা সত্ত্বেও যেহেতু তারা প্রথম মামলার বাদী এবং নির্যাতিত শিশুদের বাবা তাই তাদেরকে আসামি করা হয়নি।’

এ ব্যাপারে গোলাম মোস্তফার স্ত্রী মাসুদা খাতুন সন্ধ্যায় এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মামলার আসামি রশিদ কে তা আমি জানি না, চিনিও না। আর ইউনুস নামের যিনি আমাদের গ্রামে আছেন তিনি শিশু ইয়াসিনের বাবা ইসমাইলের শ্যালক অর্থাৎ ইয়াসিনের মামা। কিন্তু ইউনুসের বাবার নাম তো ওয়াজেদ গাজী। আবুল গাজী তো ওয়াজেদের ভাই। অথচ মামলায় যে ইউনুস গাজীকে আসামি করা হয়েছে তার বাবার নাম লেখা হয়েছে আবুল গাজী। এটা তো ঠিক না।’

নিজে মামলা করলেন না কেনো এ প্রশ্নের জবাবে মাসুদা বলেন, ‘আমি এ সব বুঝি না। ইউপি চেয়ারম্যান গাজী আনিছুজ্জামান আনিস আমাকে বলেছিলেন, মামলা না করে মীমাংসা করে নিতে। আমি তবু শ্যামনগর থানায় যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার কাছে টাকা ছিল না। তাছাড়া রাস্তায় আমাকে বাধা দিতে কয়েকজন বসেছিল বলে শুনেছিলাম।  এ জন্য  ভয়ে যাইনি থানায়। তা ছাড়া আমাকে কেউ নিয়েও যেতে চায়নি।’    

এ ছবির রহস্য উদঘাটনের জন্য জয়নগর গ্রামে বেশ কয়েকবার সরজমিনে তদন্ত করেছেন  জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মীর মোদাচ্ছের হোসেন। তিনি আজ এ মামলার ব্যাপারে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘যে কেউ বাদী হয়ে যে কারও বিরুদ্ধে, এমনকি আপনিও আমার বিরুদ্ধে মামলা দিতে পারেন। এর অর্থ এই নয় যে, আমি আসামি এবং অভিযুক্ত হয়ে গেলাম। তদন্তে  বিষয়টি প্রমাণিত হবে, কে দোষী আর কে নির্দোষ। প্রয়োজনে নতুন নাম অন্তর্ভুক্ত  হবে, কিংবা এফআইআরে বর্ণিত নাম বাদ যাবে। মামলা দায়ের করবেন বাদী আর পুলিশ তদন্ত করে অভিযোগপত্র দেবে এটাই মোদ্দা কথা। এক্ষেত্রে পুলিশের অন্য কোনো ভূমিকা নেই।  

মামলার দুই নম্বর আসামি দৈনিক পত্রদূত পত্রিকার কাশিমারী ইউনিয়নের সাবেক প্রতিনিধি সাংবাদিক রবিউল ইসলাম জানান, দ্বিতীয় ঘটনার দিন তিনি জয়নগরের ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাকে ডেকে আনা হয়। তিনি শিশু দুটির নির্যাতনের ‘সাজানো ছবি’ তোলেন।পরে আমি জানতে পেরেছি, এ ঘটনার সাথে ইলিয়াস তরফদার ও ইসমাইল জড়িত রয়েছে। কিন্তু এর আগেই তিনি সরল বিশ্বাসে ছবিটি স্থানীয় পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন। 

এ ব্যাপারে ইউপি চেয়ারম্যান গাজী আনিছুজ্জামান আনিসের ভাগ্নে জামাই ও ঘোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইলিয়াস তরফদার ছবি সাজানোর ঘটনার দিনের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘সেদিন শিশু দুটিকে আমি বাঁধিনি। বেঁধেছিলেন আমার ভাই ইসমাইল।’