রাজনৈতিক জটিলতায় ধুঁকছে খুলনার ‘জিয়া হল’
খুলনা শহরে গত শতকে আধুনিক নির্মাণশৈলীর অন্যতম স্থাপনা ‘জিয়া হল’। আজ থেকে ২৫ বছর আগে হলটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। কিন্তু নামকরণ নিয়ে রাজনৈতিক জটিলতায় দুই যুগ আগে নির্মিত স্থাপনাটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
খুলনা মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের উদ্যোগে মহানগরীর প্রাণকেন্দ্রে নয় রাস্তার সঙ্গম মুখে শিববাড়ী এলাকায় এক দশমিক ৭২১৭ একর জমির ওপর ‘পাবলিক হল কমপ্লেক্স’ নাম নিয়ে ভবনটির প্রথম পাইলিং কাজ শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। পাইলিংয়ের শেষ দিকে ১৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর কাজ আবারও বন্ধ হয়ে যায়। এর পর সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর খুলনা সিটি করপোরেশনে প্রথম মনোনীত মেয়র হিসেবে ১৯৮৮ সালে দায়িত্ব পান জাতীয় পার্টির (জাপা) সাবেক নেতা কাজী আমিনুল হক। তিনি দায়িত্ব নিয়ে অনেকটা একক প্রচেষ্টায় এক কোটি টাকা থোক বরাদ্দ এনে ১৯৮৯ সালে নির্মাণকাজ শুরু করেন। কিন্তু পরের বছরেই একতলা ভবনের ছাদ ঢালাইয়ের আগেই ১৯৯০ সালে আবার কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে শেখ তৈয়েবুর রহমানকে খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই সময়ে তিন কোটি ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে হলের নির্মাণকাজ শুরু হয়। পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ১৯৯২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ‘জিয়া হল’ নামকরণ করে ভবনটির উদ্বোধন করেন।
জটিলতার শুরু ও নামফলক পুনঃস্থাপন
প্রায় ৩০ হাজার ৩০ বর্গফুট আয়তনের এই হলের যাত্রা শুরু হয় এক হাজার ১০০ আসনবিশিষ্ট মিলনায়তন, ১৮০ আসনবিশিষ্ট সেমিনার কক্ষ, দুই হাজার ৫০০ বর্গ ফুট আকারের দুটি লাউঞ্জ, মঞ্চসংলগ্ন আসবাবপত্র কক্ষ, তিনটি মহরতকক্ষ, একটি বিশ্রামকক্ষ, দুটি লেডিস কর্নার, একটি নামাজ ঘর, মেকআপকক্ষ, অফিসসহ নানা সুবিধা নিয়ে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে হলের নামকরণ নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। সেই সময় থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সরকারি অনুষ্ঠানগুলোতে জিয়া হলের পরিবর্তে দাওয়াত কার্ড বা পোস্টারে ‘পাবলিক হল’ লেখা হতো। কোনো এক রাতে হলের নামফলকও সরিয়ে ফেলে কে বা কারা। পরে প্রথম নির্বাচিত মেয়র তৈয়েবুর রহমান স্টিল দিয়ে হলটির নামফলক পুনঃস্থাপন করেন।
সংস্কার না হওয়ায় ব্যবহার বন্ধ
২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল জিয়া হলের সংস্কারকাজের জন্য দুই কোটি টাকা বরাদ্দের নির্দেশ দেন। এর পর ২০০৮ সালে খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তালুকদার আবদুল খালেক মেয়র নির্বাচিত হন। তিনি বরাদ্দকৃত টাকা সংস্কারকাজে না লাগিয়ে জিয়া হলের স্থানে ‘সিটি সেন্টার’ প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি, হয়নি সংস্কারকাজও। আর এ কারণে ২০১১ সাল থেকে মূল মিলনায়তন এবং ২০১২ সাল থেকে পুরো জিয়া হলের ব্যবহার বন্ধ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য
তালুকদার আবদুল খালেক মেয়র থাকাকালে জিয়া হলের নিম্নমানের কাজ নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটির সদস্য এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের প্রধান ড. মুহাম্মদ হারুনুর রশিদ জানান, এই হল নির্মাণকালে তদারকির ঘাটতি ছিল। ছাদে যে মানের রড দেওয়ার কথা, তা দেওয়া হয়নি। সিমেন্ট ব্যবহারের আগে যাচাই করা হয়নি। তিনি জানান, হল নির্মাণে নকশা অনুযায়ী কাজ হয়নি।
খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রথম মেয়র কাজী আমিনুল হক বলেন, নির্মাণকাজের শুরুতে হলটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘খুলনা পাবলিক হল কমপ্লেক্স’। পরে এটির নামকরণ করা হয় জিয়া হল। এই হলের নকশা অনুযায়ী সম্প্রসারণকাজ হয়নি। দীর্ঘ দিনেও সংস্কারকাজ না করায় হলটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।
তৈয়েবুর বলেন, ভবন ব্যবহারের অনুপযোগী হলে সরকারি একটি কমিটি সেটিকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। কিন্তু খুলনার এই হলটি ব্যবহার না হলেও সেই কমিটি সেটিকে অনুপযোগী ঘোষণা করেনি। তিনি বলেন, হলটি দ্রুত সংস্কারকাজ করে ব্যবহার উপযোগী করা দরকার। হল না থাকায় খুলনার সাংস্কৃতিক অঙ্গন মুখ থুবড়ে পড়েছে।
খুলনা গণপূর্ত বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী ওয়াসিফ আহমাদ জানান, খুলনা লবণাক্ত এলাকা হলেও কোনো পাকা ভবন ৫০ বছরের আগে ব্যবহারের অনুপযুক্ত হওয়ার কথা নয়। তিনি বলেন, খুলনায় পাকিস্তান ও ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ভবনগুলো এখনো ব্যবহারের উপযোগী আছে।
খুলনার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতা শাহীন জামাল এবং আব্বাসউদ্দিন একাডেমীর এনামুল হক হলটি ব্যবহারের অনুপযোগী থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁদের ভাষ্য, বিভাগীয় শহর খুলনায় এই মুহূর্তে এক হাজারের বেশি লোকের উপস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠান করার জন্য কোনো হল নেই। এতে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রতিভার বিকাশ ঘটছে না।
খুলনা সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল একটি সূত্র নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে জানায়, ১৯৯০ সালের দিকে খুলনায় ভেজাল সিমেন্টের রমরমা ব্যবসা ছিল। সেই ভেজাল সিমেন্টের কারণে হলটির নির্মাণকাজ বাজে হয়েছে।
এই সূত্রটি আরো জানায়, সিটি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেকের সময়কালে নতুন করে সিটি সেন্টার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। বরাদ্দও ছিল ২৪ কোটি। কিন্তু জিয়া হলটি ভাঙ্গা বা অপসারণের কোনো প্রকল্প ছিল না।
২০১৩ সালের নির্বাচনে বিএনপি নেতা মনিরুজ্জামান মনি মেয়র নির্বাচিত হলেও পূর্বসূরীদের মতো তাঁর প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা নেই। তিনি জিয়া হলের অপসারণের জন্য ৬০ কোটি ৩৫ লাখ টাকার প্রকল্প দাখিল করলেও মন্ত্রণালয় থেকে তার অনুমোদন পাননি। বলা হয়েছে, বর্তমান মেয়রের সময়কাল শেষ। তাই আগামী নির্বাচনের পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জিয়া হলের নির্মাণকাজের তদারকিতে ছিলেন খুলনা সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নাজমুল আহসান খান। কর্তব্য অবহেলার দায়ে হল নির্মাণের সময় তিনি সাময়িক বরাখাস্ত হয়েছিলেন।
এ বিষয়ে নাজমুল আহসান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি নির্মাণে কোনো অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, নকশা অনুযায়ী সব হয়েছে।
দুই যুগ পর ভবনটির বেহাল অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে নাজমুল বলেন, সংস্কারকাজ না করায় এই চেহারা হতে পারে। তিনি জানান জিয়া হলের ওই স্থানে সিটি সেন্টার প্রকল্পর কোনো নকশা তৈরি হয়নি, কোন অনুমোদনও আসেনি।
খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুজ্জামান জানান, তিনি দায়িত্ব নিয়ে পাবলিক হল নিয়ে কাজ শুরু করার আগেই জেলে চলে যান। জেল থেকে এসে সিটি সেন্টার নির্মাণের জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে অনুমোদন চাইলে, মন্ত্রণালয় সামনে নির্বাচন আছে অজুহাতে অনুমোদন দেয়নি। ফলে তাঁরা সংস্কারকাজও করতে পারছেন না, আবার সিটি সেন্টার নির্মাণকাজও শুরু করতে পারছেন না।