ডিমলার সবাই এ দেশে থাকতে চান
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার ভারতীয় ছিটমহলবাসী সবাই এ দেশেই থাকতে চান। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহল থেকে মূল ভূখণ্ড ভারত যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন প্রায় দেড় হাজার মানুষ। তবে এর মধ্যে ডিমলা উপজেলার অভ্যন্তরে চারটি ছিটমহলের কেউ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৩১ নম্বর নগর জিগাবাড়ী ছিটমহলের বাসিন্দা ভরত চন্দ্র রায় ও সনাতন চন্দ্র রায় ভারতে যাওয়ার জন্য নিবন্ধন করলেও পরে তাঁরা তা বাতিলের জন্য আবেদন জানান। পরবর্তী সময়ে তাঁদের দাবি মেনে নেওয়া হয় বলে এনটিভি অনলাইনকে জানান ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেজাউল করিম।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী ভারতীয় ছিটমহলবাসী মনে করছেন, ভারতীয় ভূমিতে তাঁদের জন্ম হলেও মূলত এ দেশেই তাঁরা লালিত-পালিত হয়েছেন। এ দেশের জনগোষ্ঠীর সঙ্গেই তাঁদের আত্মীয়তা। এ বন্ধন ছিন্ন হওয়ার নয়।
জিগাবাড়ী ছিটমহলের অতুল চন্দ্র রায়ের তিন ছেলের মধ্যে ভরত চন্দ্র ও সনাতন চন্দ্রের পরিবারের নয় সদস্য প্রথমে ভারত যাওয়ার জন্য জনগণনায় নিবন্ধন করেন। ভরত চন্দ্র, তাঁর স্ত্রী গীতা রানী, তিন ছেলে সুশান্ত, জয়ন্ত ও শুভ গত ১১ জুলাই নিবন্ধন করেন। আর সনাতন চন্দ্র, তাঁর স্ত্রী মিনতী রানী, দুই মেয়ে সুবর্ণা ও বন্যা ১৩ জুলাই ভারতের নাগরিকত্বের জন্য নিবন্ধন করেন।
কিন্তু অতুল চন্দ্র রায়ের বড় ছেলে রঞ্জিত কুমার রায়, তাঁর স্ত্রী জয়ন্তী রানী ও ছেলে প্রশান্ত চন্দ্র রায় ১৪ জুলাই বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য নিবন্ধন করেন। এ নিবন্ধনের আগে বাংলাদেশি নিবন্ধিত পরিবারগুলো ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণে কী কী সুযোগ-সুবিধা পাবেন, তা জানতে চান। তার পরই তাঁরা এ দেশে থাকার জন্য নিবন্ধন করেন।
কিন্তু ভারতের নিবন্ধন করার পর মত পাল্টান ভরত চন্দ্র ও সনাতন চন্দ্র। তাঁরা বাংলাদেশের নাগরিকত্বের জন্য নতুন করে নিবন্ধনের দাবি করেন। একপর্যায়ে নিবন্ধন বাতিল করা না হলে আত্মহত্যা করবেন বলেও হুমকি দেন। পরে তাঁদের আবার বাংলাদেশে থাকার জন্য নিবন্ধন দেওয়া হয়।
ডিমলা উপজেলার অভ্যন্তরে বড় খানকি ছিটমহলের বাসিন্দা এন্তাজ আলী, চন্দ্র বানুসহ অনেকে জানান, বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়স্বজন বসবাস করেন। ভারতের সুযোগ-সুবিধা তাঁরা নিতে পারেন না। তাঁদের বাপ-দাদারাও এই ছিটমহলে বসবাস করে মারা গেছেন। এই ছিটমহল থেকে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের দূরত্ব কম হওয়ায় বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে বসবাস করতে পারলে তাঁরা বেশি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
অপর বাসিন্দা মঞ্জুয়ারা জানান, তাঁর আদি বংশধররা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহলে বসবাস করে আসছেন। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন হলে তাঁরাও বাংলাদেশেই রয়ে যাবেন।
মূলত জন্মস্থান ত্যাগ করে বিদেশ-বিভুঁইয়ে অনিশ্চিত জীবনের জন্য কোনো ঝুঁকি ছিটমহলবাসী নিতে চান না। ভারতীয় ছিটমহলে তাঁরা থাকলেও এ দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব সুযোগ-সুবিধা পরোক্ষভাবে ভোগ করেছেন, যা হারানো তাঁদের জন্য বড়ই ক্ষতির কারণ ছিল। ছিটমহলে জন্ম হলেও পরিচয় গোপন করে অনেকেই এ দেশে সরকারি-বেসরকারি চাকরি করছেন।
ছিটমহলের বাসিন্দারা মূলত গরিব শ্রেণির। তাঁরা প্রায় সবাই দিনমজুর ও ছোটখাটো ব্যবসা করেন। তাঁদের দিন আনি দিন খাই অবস্থা। আর ছিটমহলের ৭০ শতাংশ ভূ-সম্পত্তির মালিক এ দেশীয় প্রভাবশালীরা। ফলে দরিদ্র আর হতদরিদ্রদের জন্য রাষ্ট্রবদলে তেমন কোনো ফায়দা হবে না ভেবেই অনেকে এ দেশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মায়া-মমতা, অর্থনৈতিক দক্ষতা, উদারতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সহনশীলতা তাঁদের এ দেশে থাকার জন্য অনুপ্রাণিত করেছে বলে জানান ছিটমহলবাসী।
যাঁরা ভারতে যেতে চেয়েছেন, তাঁদের আত্মীয়স্বজন ভারতে রয়েছেন—এমন একটা ভাবনাই কাজ করেছে বলেও মনে করেন অনেকে।
ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি ভারত ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত জানান, প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেখা গেছে, ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশি ছিটমহলগুলো থেকে কোনো ছিটবাসী বাংলাদেশে আসার পক্ষে মতামত দেননি। আর বাংলাদেশের অভ্যন্তরের ভারতীয় ছিটমহলগুলো থেকে মূল ভূখণ্ড ভারত যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে প্রায় দেড় হাজার ছিটবাসী। তবে এর মধ্যে নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার অভ্যন্তরে চারটি ছিটমহলের কেউ নেই।