রোহিঙ্গা নারীদের জীবনে ‘চোরাগোপ্তা টান’
সেনাবাহিনীর নির্যাতন-হত্যা আর ধর্ষণের মুখে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশের উপকূলবর্তী অস্বাস্থ্যকর শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা কিশোরী-নারীদের জীবন কাটছে চরম অপুষ্টি আর দারিদ্র্যের কঠোর কশাঘাতের মধ্যে। এই দুর্বিষহ অবস্থায় শুধু দুমুঠো ভাত আর বেঁচে থাকার তাগিদ—এই কিশোরী-নারীদের যৌন পেশার মতো ‘চোরাগোপ্তা পথে’ পা বাড়াতে বাধ্য করছে।
গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। প্রতিদিন নতুন করে বাংলাদেশ সীমান্তে এসে ভিড় করছে রোহিঙ্গা সদস্যরা। এ ঘটনাকে ‘জাতিগত নিধনের ধ্রুপদি’ উদাহরণ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে জাতিসংঘ।
বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা এরই মধ্যে ১১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই অস্বাস্থ্যকর ক্যাম্পে বসবাস করছে। এটি এক মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। পালিয়ে আসাদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি, যাদের ওপর পাচারকারীদের লোলুপদৃষ্টির বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে এরই মধ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা।
কিন্তু এরই মধ্যে ঘিঞ্জি পরিবেশ আর মুসলিম সমাজের কঠোর রক্ষণশীলতার মধ্যেও তলে তলে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালংয়ের শরণার্থী ক্যাম্পের নারী ও কিশোরীদের ঘিরে জমজমাট যৌন ব্যবসার অন্ধকার দিক তুলে ধরা হয়েছে গণমাধ্যম রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে।
খদ্দের হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্থানীয় রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সমাজের কোন প্রভাবশালী নেই সেখানে! ক্যাম্পের পুরোনো বাসিন্দাদের দিয়ে চালানো এই ব্যবসার লাগাম যাদের হাতে, সেই দালাল আর খদ্দেরদের চোখ এখন নতুন আসা অসহায়-সম্বলহীন-ঠিকানাবিহীন নারী-কিশোরীদের দিকেও।
প্রতিবেদক স্তেফানি গ্ল্যানস্কি প্রতিবেদনটি শুরু করেছেন এভাবে, “কালো চাদর গায়ে চারজন নারী একটি পরিষ্কার মাটির ঘরে প্রবেশ করলেন, তারপর মেঝেতে আড়াআড়িভাবে হাঁটু গেড়ে বসলেন তাঁরা। যখন তাঁদের পয়সার বিনিময়ে যৌনতার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়, তখন তাঁরা খুব অস্বস্তিতে পড়েন এবং নীরব থাকেন।
এক কাপ চা খাওয়ার পর আবার সেই প্রসঙ্গটি ফিরে আসে। তখন নারীরা একে অপরের চোখের দিকে তাকায়। তার পর ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে একজন ঘরের দরজা বন্ধ করে দেন, আরেকজন বন্ধ করেন জানালা। ছোট্ট, স্যাঁতসেঁতে ঘরটির মধ্যে অন্ধকার গাঢ় হয়ে আসে। আর এক তরুণীর চাপা কণ্ঠ থেকে ভেসে আসে, ‘কেউ যদি জানতে পারে আমরা আসলে কী করি, তাহলে আমাদের খুন করে ফেলা হবে।’”
রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর মধ্যে ১৯৯২ সালে তৈরি কুতুপালং সবচেয়ে বড়। আর এখানেই জাঁকিয়ে বসেছে যৌন ব্যবসা। যাঁরা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁদের অধিকাংশই দীর্ঘদিন ধরে এসব ক্যাম্পে বাস করছেন। হাজার হাজার অসহায় নারী-কিশোরী এই ব্যবসাকে টিকিয়ে রেখেছেন।
যৌনকর্মী আর খদ্দেরের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন ক্যাম্পের বাসিন্দা নূর (একজন নারী ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘কুতুপালং ক্যাম্পে পাঁচশর মতো যৌনকর্মী রয়েছে। দালালের চোখ এখন নতুন যারা আসছে, তাদের দিকে।’
ক্যাম্পের দেখভালের দায়িত্বে থাকা জাতিসংঘ জানিয়েছে, ঠিক কতজন নারী ও কিশোরী এ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন, এ ব্যাপারে তাঁদের কাছে কোনো তথ্য নেই। জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএর কর্মকর্তা সাবা জারিভ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, ‘এর সঠিক হিসাব বের করা কঠিন, এ ধরনের কোনো তথ্য আমাদের নেই।’
‘গুজব’
সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বসবাসের অনুপযোগী শরণার্থী ক্যাম্পের নারী ও শিশুদের প্রতি পাচারকারীদের শ্যেনদৃষ্টি রয়েছে। যদিও রক্ষণশীল মুসলিম সমাজে যৌনবৃত্তিকে নিষিদ্ধ কাজ হিসেবে দেখা হয়।
যৌনকর্মী আর খদ্দেরের মধ্যস্থতাকারী নারী নূর বলেন, ‘সবাই এমন ভাব দেখায় যে এখানে এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই। এখানকার নারীরা তাদের বাংলাদেশি খদ্দেরদের সঙ্গে ক্যাম্পের বাইরে মিলিত হয়। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তারা ঘুমায় না। আমাদের সমাজ খুবই রক্ষণশীল, এখানে গুজব খুব দ্রুত ছড়ায়। সব নারীই তো নিজের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তিই চায়।’
এই পেশায় যারা আসছে, তাদের অধিকাংশই শিশু। তারা সারা দিনে হয়তো একবেলা ভালোভাবে খাবার জোটাতে পারে না, স্কুল কী জিনিস জীবনে হয়তো কোনোদিন দেখেনি। এমনকি তারা যে এই কাজে যুক্ত, অনেক ক্ষেত্রে তাদের বাবা-মা এটা জানে না।
১৮ বছরের রীনা এক দশক ধরে এই ক্যাম্পে বসবাস করছেন। দুই বছর আগে একজন মাদকাসক্তের সঙ্গে তাঁকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই স্বামী তাঁর সঙ্গে দুর্বব্যবহার করতেন, এমনকি মারধরও করতেন। প্রথম সন্তান হওয়ার পর স্বামী রীনাকে ছেড়ে চলে যান। কর্মহীন রীনার জন্য তখন বাচ্চার মুখে খাবার দেওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে।
‘ঠিক সেই সময়টাতেই আমি যৌনকর্মী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আমার বয়স তখন মাত্র ১৬, কিন্তু এসব চিন্তা করলে তো আমার চলবে না। আমার তখন টাকার প্রয়োজন ছিল’, যোগ করেন রীনা।
রীনার মতোই অসহায় ১৪ বছরের কামরু। ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী সহিংসতা শুরু করলে পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেয় সে। পরিবার এতটাই গরিব যে কোনোদিন স্কুলে যেতে পারা তো স্বপ্নের ব্যাপার, ঠিকমতো খাবারই জোটেনি কামরুর। যদিও অন্য অনেক নারীর মতো কামরু তার আসল পরিচয় জানাতে চায়নি।
ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির লৈঙ্গিক-সমতাবিষয়ক বিশেষজ্ঞ লিসা একেরো বলেন, ‘যদি বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলো শরণার্থীদের একেবারে ন্যূনতম প্রয়োজনীয়তাটুকু মেটাতে না পারে, তাহলে নারী-শিশুদের পাচারের শঙ্কা বাড়বে। যদি এখানে টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তোলা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে আমরা দেখব এখানে পাচারের ঝুঁকি বাড়ছে।’
‘যৌনবৃত্তির স্খলন’
ক্ষুধা, দারিদ্র্য থেকে মুক্তি আর বেঁচে থাকার জন্য রমিদার কাছে যৌনবৃত্তিই ছিল একমাত্র পথ। তিনি বলেন, ‘আমি তখন সবকিছুই করতে পারতাম। আমার নিজের কোনো পছন্দ ছিল না।’
রমিদার প্রথম খদ্দের ছিল তাঁর এক বাংলাদেশি বন্ধু। এক হাজার টাকা পেয়েছিলেন তখন। এর বাইরে যাতায়াত বাবদ আরো ২০০ টাকা পান। যদিও এর অর্ধেক দালালকে দিয়ে দিতে হয়। রমিদা জানান, এরপর ওই বাংলাদেশি বন্ধু তাকে আরো ডেকে নেয়। মূলত মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই এ ব্যবসা হয়। দালালরা জানিয়ে দেন, কোথায় যেতে হবে। তবে একই খদ্দেরের কাছে খুব বেশি যান না যৌনকর্মীরা। কারণ, এতে সমস্যায় পড়ার আশঙ্কা থাকে।
রমিদা প্রতি সপ্তাহে হয়তো বড়জোর তিনজন খদ্দেরকে সামলান। তিনি বলছিলেন, ‘আমি অনেক সময় কাজের জন্য কক্সবাজারে যাই। দুই ঘণ্টার পথ। আমি যখন শহরে যাই, তখন একটা ছুতা বের করি। হয়তো কোনো আত্মীয়বাড়ি বা মার্কেটে কেনাকাটা করতে যাওয়ার কথা বলি।’
রোহিঙ্গা নারীদের খদ্দেরদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, স্থানীয় রাজনীতিবিদ থেকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষই আছে। শিক্ষার্থী আলী (২৩) তেমনি একজন। তিনি রয়টার্সকে বলছিলেন, উৎসবে তিনি হয়তো কোনো নারীর সঙ্গে ঘুমান। তবে বিয়ে করার জন্য তিনি ‘কুমারী’ই চাইবেন।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অনেক খদ্দের নিরাপত্তার কোনো সামগ্রী ব্যবহার করেন না। যদিও রমিদা জন্মনিরোধক ইনজেকশন ব্যবহার করেন, তারপরও এটা তাঁর জন্য ভয়ের। কারণ এইডসের ভয় কাজ করে তাঁর মধ্যে। যদিও রমিদা কখনো তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাননি।
‘নিরাপদ আবাস’
ক্যাম্প থেকে আধা ঘণ্টা গাড়িতে গেলেই রাস্তার পাশে একটি ডরমিটরিসদৃশ ভবন দেখা যাবে। বাড়িটির চারপাশে ধানের ক্ষেত। এই ভবনে ৩০ জন বসবাস করতে পারেন। এই বাড়িটি আসলে রোহিঙ্গা নারীদের একটি আশ্রয়কেন্দ্র। গিয়ে কথা বলে জানা যায়, সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে এই ভবনের সংস্কারকাজ করা হচ্ছে। সেখানে রোহিঙ্গা নারীদের জন্য একজন মনোবিজ্ঞানীও রয়েছেন।
এই আশ্রয়কেন্দ্রে ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খোরশিদা খাতুন। তিনি বলছিলেন, ‘এখানে যারা আসে, তারা তাদের জীবনে কী ঘটেছে এটা নিয়ে কথা বলতে চায় না। কারণ, এতে তাদের ঝামেলায় পড়তে হতে পারে। ধর্ষণের শিকার নারী, সিঙ্গেল মাদার বা যৌনকর্মী যে কেউ এখানে আসতে পারে।’
মূলত এখানে যাঁরা আসেন, তাঁদের জন্য কর্তৃপক্ষ নানা ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। যাতে তাঁরা জীবনকে আবার নতুন করে শুরু করতে পারেন।