‘হোয়াটসঅ্যাপে’ রোহিঙ্গাদের জন্য কী তথ্য আসে

Looks like you've blocked notifications!
ছবি : রয়টার্স

পাহাড়ের পাশে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালংয়ে শরণার্থী ক্যাম্পের সামনে নিজের মুদি দোকানে বসে বেচাকেনা করছিলেন রোহিঙ্গা মুসলিম যুবক মমতাজ-উল-হক। এক ফাঁকে মোবাইলে থাকা একটি রেকর্ডিং ছেড়ে দিলেন। উচ্চ স্বরে সেখানে একজন স্থানীয় ভাষায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য ও সেখানকার রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে খবর দিচ্ছেন। সেটা শোনার জন্য পথচারী আর শিশুদের জটলা বেঁধে গেল মমতাজের দোকানের সামনে।

মমতাজ (৩০) বলছিলেন, ‘এটা আমি প্রতিদিনই শুনি, কারণ এর মাধ্যমেই আমি মাতৃভূমি মিয়ানমার সম্পর্কে অনেক তথ্য পাই।’ তিনি জানাচ্ছিলেন, মোবাইলে বিভিন্ন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে এসব খবর প্রচার করা হয়। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের প্রস্তাব নিয়ে সেদিন খবরে তথ্য দেওয়া হচ্ছিল। 

১৯৯২ সালে রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার মধ্যে মমতাজের পরিবার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। জন্ম রাখাইনে হলেও মমতাজ বেড়ে উঠেছেন কুতুপালংয়ের শরণার্থী ক্যাম্পে। উপকূলের এসব শরণার্থী ক্যাম্পে আছেন প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা, যাদের মধ্যে ছয় লাখের বেশি এসেছে গত ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে নতুন করে সহিংসতা শুরুর পর।

সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসার সময় রোহিঙ্গারা চালের বস্তা, পাত্র, জগ, মোবাইল ফোন, চার্জ দেওয়ার জন্য সোলার প্যানেল এসব জিনিস নিয়ে আসে। এদের মধ্যে কিছু মানুষ প্রতিনিয়তই মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সেই সংবাদের জন্য উদগ্রীব থাকেন।

রোহিঙ্গাদের মধ্যে অধিকাংশই স্বল্পশিক্ষিত। এই কারণে ভিডিও বা অডিওর মাধ্যমে মূলত তাদের মধ্যে খবর প্রচার হয়। এসব খবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপের বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে এগুলো এক ধরনের কমিউনিটি রেডিও মতো কাজ করে। 

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের জানার আগ্রহের শেষ নেই। এই ঘাটতি পূরণের জন্যই হোয়াটসঅ্যাপে বেশ কিছু গ্রুপ সক্রিয়। এইসব গ্রুপে রাখাইনের সহিংতার ভিডিও, বিভিন্ন গ্রাম থেকে হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ও নাম-পরিচয় জানতে পারেন রোহিঙ্গারা। এমনকি স্থানীয় ভাষায় একজন শরণার্থী ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের কীভাবে জীবনযাপন করা উচিত, এসব বিষয়েও কথা বলেন।

‘শতভাগ বিশ্বস্ত’

উখিয়ার লেদা শরণার্থী ক্যাম্পের পাশের দোকানটিতে কোমল পানীয় বিক্রি করছিলেন দোকানি। এর ফাঁকে মোবাইলে উচ্চ স্বরে ছেড়ে দিলেন ‘হোয়াটসঅ্যাপ নিউজ’। বার্তাটি যিনি পাঠ করছিলেন, তিনি স্থানীয় ভাষা ব্যবহার করছিলেন। রাখাইনের বুথিডং থেকে বাংলাদেশে শরণার্থী হয়ে আসা মোহাম্মদ জোবায়ের এক নিশ্বাসে সেই বার্তাটি রয়টার্সকে অনুবাদের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন।

‘মিয়ানমারের সেনাবাহিনী গ্রামকে ঘিরে ফেলেছে। তারপর সেনাসদস্য ও মগরা গ্রামের লোকজনের ওপর হামলা চালায়। এতে কিছু লোক আহত হয়েছে,’ কথাগুলো বলার সময় জুবায়েরের চোখেমুখে ঘৃণা ফুটে উঠেছিল।

যদিও জুবায়ের বলছিল, এসব তথ্য তাঁরা শতভাগ বিশ্বাস করেন। হোয়াটসঅ্যাপের একেকটি গ্রুপে শত শত সদস্য থাকে। এই সদস্যদের মাধ্যমেই এসব তথ্য ক্যাম্পের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এসব তথ্য আসলে কোথায় থেকে ছাড়া হয় বা প্রকৃতপক্ষে এর সত্যতা আছে কি না, সে সম্পর্কে সাধারণ রোহিঙ্গা শ্রোতাদের কোনো ধারণাই নেই। অনেকে অবশ্য এটাও বলছিলেন যে, অনেক ক্ষেত্রেই পুরোনো আর অবিশ্বাসযোগ্য তথ্য ছড়ানো হয়।

কুতুপালং ক্যাম্পের চা বিক্রেতা রয়টার্সকে বলছিলেন, ‘অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, মিয়ানমারের কোনো একটি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার তথ্য দেওয়া হয়েছে। পরে আমরা সেই গ্রামের লোকজনের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করলে দেখা যায় সে ধরনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি।

অনেক শরণার্থী এটাই বললেন যে, অন্যান্য দেশের সহিংসতার ভিডিও ফুটেজও মিয়ানমারের রাখাইনের বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

‘অন্ধকারে শোনা’

এর অবশ্য একটা গুরুতর দিকও আছে। কারণ, এ সুযোগে এমন অনেক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ গজিয়ে উঠেছে, যারা আসলে রোহিঙ্গাদের প্রকৃত সমস্যাকে আড়ালে রেখে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নেরও কৌশল নিচ্ছে। 

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে ৩০টি পুলিশ ও সেনাক্যাম্পে বিদ্রোহীরা হামলা চালায়। এ হামলার জের ধরে দেশটির সেনাবাহিনীর নির্মম পাল্টা আক্রমণের মুখে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। দেখা যাচ্ছে, আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামে একটি ‘ছায়া-গোষ্ঠী’ এই উগ্র তৎপরতা ও হামলার নেপথ্যে রয়েছে।

শরণার্থী ক্যাম্পের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আরসার সদস্য বা অনুসারীরা খুবই সক্রিয়। তারাই এসব বার্তা সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। সেখানে আরসাকে সমর্থনের পাশাপাশি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতনের তথ্যও তুলে ধরা হচ্ছে। আবার কিছু গ্রুপ আছে, যেখানে আরসার নিজস্ব বিজ্ঞপ্তিগুলো প্রচার করা হয়।

যদিও ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, এসব তথ্য, অডিও, ভিডিও কারা আপলোড করেন বা কোথায় থেকে আপলোড করা হয়, সে সম্পর্কে তাদের কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। তবে যেসব মোবাইল নম্বর থেকে এসব পোস্ট দেওয়া হয়, সেসব নম্বর মধ্যপ্রাচ্য বা এশিয়ার অন্যান্য দেশে। ফলে স্বাভাবতই ধারণা করা যায়, তারা আরসার সদস্য।

তবে জমায়েত হয়ে এভাবে খবর শোনা নিয়ে এখন সতর্ক হয়ে যাচ্ছেন ক্যাম্পের রোহিঙ্গা বাসিন্দারা। এরই মধ্যে তাঁরা দিনের বেলায় প্রকাশ্যে জমায়েত হয়ে খবর শোনা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন তাঁরা গোপনে রাতের অন্ধকারে খবর শোনেন। আর বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা ক্যাম্পে আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকা আরসার সদস্যদের ওপর নজরদারি রাখেন।

এত কিছুর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বার্তা বা তথ্য জোগানের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের উজ্জীবিত রাখার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে মনে করেন কুতুপালং ক্যাম্পের চা দোকানি মমতাজ-উল-হক। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা নিজেদের মধ্যে সংঘবদ্ধ নয়। ফলে নিজেদের মধ্যে হতাশ বহিঃপ্রকাশ এভাবে ঘটানো ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।’