শুধু ‘আল্লাহর কাছেই’ জবাব দেবেন ইফা কর্মকর্তা!
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নওগাঁর এক মাঠ কর্মকর্তার (ফিল্ড অফিসার) বিরুদ্ধে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নিজ তত্ত্বাবধানে থাকা কেন্দ্রগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করার কথা থাকলেও তিনি তা করেন না। নিয়ম না থাকলেও প্রকল্পের মোটরসাইকেল ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছেন। আবার তাঁর পেট্রলের খরচও নিচ্ছেন প্রকল্প থেকে। প্রকল্পের ব্যয়ের কোনো হিসাব দিতেও তিনি রাজি নন।
এই মাঠ কর্মকর্তার নাম মুত্তাকিনুল ইসলাম। ইসলামিক ফাউন্ডেশন (ইফা) সূত্রে জানা যায়, নওগাঁর ১১ উপজেলায় প্রায় ৮০০টি কেন্দ্রের মাধ্যমে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এখন চলছে ওই প্রকল্পের ষষ্ঠ পর্যায়ের কাজ। মাঠপর্যায়ে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম সঠিকভাবে হচ্ছে কি না, সে বিষয় মনিটরিং করার জন্য প্রতিটি উপজেলায় রয়েছে একাধিক কেয়ারটেকার, একজন মডেল কেয়ারটেকার এবং একজন ফিল্ড সুপারভাইজার। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিদিন একজন কেয়ারটেকার, মডেল কেয়ারটেকার ও ফিল্ড সুপারভাইজার কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫টি করে কেন্দ্র পরিদর্শন করার কথা। এদের প্রত্যেককে স্ব স্ব উপজেলায় অবস্থান করেই কার্যক্রম পালনের কথা। এ জন্য প্রতি ফিল্ড সুপারভাইজারকে প্রতি মাসে ২০ থেকে ৩০ লিটার পেট্রল দেওয়া হয়।
কিন্তু ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফিল্ড সুপারভাইজাররা নিয়মনীতি মানছেন না। তারা অফিসের মোটরসাইকেলের জ্বালানি অপব্যবহার করে ব্যক্তিগত কাজে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যে উপজেলায় কর্মস্থল সেখানে অবস্থান না করে অফিসের মোটরসাইকেলের তেল পুড়িয়ে নিজ বাড়িতে গিয়ে রাত্রিযাপন করছেন। এদের একজন ফিল্ড অফিসার মুত্তাকিনুল ইসলাম। তিনি নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রতিদিন অফিস শেষে প্রকল্পের মোটরসাইকেল নিয়ে যাতায়াত করেন। প্রকল্পের টাকার তেল পুড়িয়ে নওগাঁ জেলা সদর থেকে প্রায় ৬০-৭০ কিলোমিটার দূরে তাঁর নিজ গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবিতে যাতায়াত করছেন।
প্রতিদিন জেলার বাইরে যাওয়া, সময়মতো অফিস না করা এবং ফিল্ড সুপারভাইজরদের মনিটরিং না করায় পুরো প্রকল্পের কার্যক্রমকে হুমকির মুখে পড়েছে।
টাকা খরচের হিসাব নেই
ইসলামিক ফাউন্ডেশন (ইফা) নওগাঁ অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলার ১১ উপজেলার ৮০০টি কেন্দ্রের বিপরীতে ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসের জন্য মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য অর্থ বরাদ্দ এসেছে এক কোটি ২৪ লাখ দুই হাজার ২১৩ টাকা। জুনের মধ্যে ওই প্রকল্পের খরচের হিসাব সম্পন্ন করার নিয়ম থাকলেও এখনো খরচের হিসাব দাঁড় করাতে পারেননি অফিসের ফিল্ড অফিসার মুত্তাকিনুল। ওই সময়ে কোন খাতে কত টাকা ব্যয় হয়েছে তাও তিনি দিতে পারেননি।
ওই অফিসের এক ফিল্ড সুপারভাইজার জানান, শুধু তাই নয়, পঞ্চম পর্যায়ের প্রকল্পের কার্যক্রম ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়েছে। ওই সময়ের হিসাবও এখন পর্যন্ত ক্লোজ করা হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই অফিসের একজন মাঠকর্মী বলেন, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ষষ্ঠ পর্যায়ের প্রকল্প কার্যক্রম শুরু হয়। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত কেন্দ্র ও শিক্ষক বাছাই করতে সময় চলে যায়। কিন্ত এ সময়ে সব ফিল্ড সুপারভাইজার, ফিল্ড অফিসার ও কর্মকর্তাদের ভ্রমণ ভাতা (টিএ) ও দৈনিক ভাতা (ডিএ) দেওয়া হলেও আবার দু-একজনের টিএ-ডিএ স্থগিত করে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া গত অক্টোবর-নভেম্বর মাসে অফিসের হিসাবরক্ষকের সঙ্গে যোগসাজশ করে ফটোকপি মেশিন মেরামত, মোটরসাইকেলের তালা ক্রয়, স্টেশনারি মালামাল ক্রয়, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও পরিবহন খাতের নামে ভুয়া বিল-ভাউচারের মাধ্যমে লক্ষাধিক টাকা আত্মসাৎ করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এভাবেই অনিয়মতান্ত্রিক অবস্থার মধ্যে নওগাঁয় চলছে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম।
যা বললেন মুত্তাকিনুল
ফিল্ড সুপারভাইজার ও কেয়ারটেকারদের ব্যাপক অনিয়মের বিষয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশন নওগাঁর ফিল্ড অফিসার মুত্তাকিনুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলা হলে তিনি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে উগ্র আচরণ করেন। তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রতিদিনই তিনি অফিসের মোটরসাইকেল জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলায় নিয়ে যান। এতে কোনো প্রকার অন্যায় হলে তিনি ‘আল্লাহর কাছে জবাব’ দেবেন।
এ কথা বলেই মুত্তাকিনুল ইসলাম কক্ষ থেকে বের হয়ে যান।
উপপরিচালকের বক্তব্য
এ ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নওগাঁর উপপরিচালক (ডিডি) মো. সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলা হলে তিনি জানান, ‘ফিল্ড অফিসার মুত্তাকিনুল ইসলাম একজন মানসিক রোগী। অফিসের সবার সঙ্গে তিনি উগ্র আচরণ করেন।
কোনো বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করা যায় না। অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ ও ফিল্ড সুপারভাইজাদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কের (গোপন আঁতাত) কারণে তাঁকে নওগাঁ থেকে অন্যত্র বদলির জন্য কয়েক দফা ডিজি (মহাপরিচালক) অফিস বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি তাঁর বদলির ব্যবস্থা হয়নি। ফিল্ড অফিসারের কার্যক্রমের জন্য আমি নিজেও সব সময় বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে থাকি।’
সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করা এবং বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের মধ্যে থেকেও কীভাবে শিক্ষক, কেয়ারটেকার ও ফিল্ড সুপারভাইজাররা নিয়মিত বিল পাচ্ছেন? জবাবে সাইফুল ইসলাম জানান, ‘ফিল্ড সুপারভাইজার ও কেয়ারটেকাররা সরাসরি ফিল্ড অফিসারের নিয়ন্ত্রণে। ফিল্ড সুপারভাইজার ও কেয়ারটেকাররা ভ্রমণসহ অন্যান্য বিল ফিল্ড অফিসার মুত্তাকিনুল ইসলামের কাছে দাখিল করেন। সেটা যাচাই করেন সহকারী পরিচালক জাকিউজ্জামান।
তার পর আমার টেবিলে বিল এলে বিলে আমাকে সই করতেই হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম করলে ফিল্ড অফিসার ও সহকারী পরিচালক করে থাকতে পারেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিলে আমার স্বাক্ষর হতে দেরি হলে ফিল্ড অফিসার বিল ছেড়ে দেওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দেন। এ ক্ষেত্রে আমার কিছু করার থাকে না। সঠিকভাবে যাচাই করেই বিল প্রদান করা হয়। কোনো অনিয়ম হয় বলেও আমার জানা নেই।’