নীলক্ষেতে মিলছে বুয়েট, ঢাবির ‘আসল’ সনদ!

Looks like you've blocked notifications!
ফাইল ছবি

কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতারই প্রয়োজন হয় না, শুধু টাকা খরচ করলেই মিলে যাচ্ছে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডসহ বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও মেডিকেল কলেজের সনদ (সার্টিফিকেট)। এ ছাড়া মিলে যাবে জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ব্যাংক সার্টিফিকেটসহ যেকোনো সনদ।

রাজধানীর নীলক্ষেতে চলছে এ সনদ কেনাবেচার মহোৎসব। শুধু নীলক্ষেতেই সীমাবদ্ধ নেই এই জাল সনদ কেনাবেচার পসরা। এ চক্রের দৌরাত্ম্য এখন সারা ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে। দিনের চেয়ে রাতে বেশি চলছে এ অবৈধ কর্মকাণ্ড। বিভিন্ন কৌশল আর প্রযুক্তি ব্যবহার করে অসাধু এ চক্র এ কর্মকাণ্ড বাড়িয়েই যাচ্ছে।

এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর এম এ আমজাদ আলী। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের কাজের সঙ্গে যার জড়িত, তাদের ধরার জন্য সঠিক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। সঠিক প্রমাণ পেলে আমার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
 
বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা টাকার বিনিময়ে সার্টিফিকেট তৈরির কাগজ পাচার করে কি না—এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রক্টর বলেন, ‘এ প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সরেজমিনে নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটে ফাইল হাতে ঢুকতেই চারপাশ থেকে ডাকাডাকির ধুম পড়ে যায়। অসাধু চক্র বলতে শুরু করে, ‘সার্টিফিকেট লাগবে, কম টাকায় মূল সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে।’ 

একাধিক দোকানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায় আরো বিস্ময়কর তথ্য। পরিচয় গোপন রেখে কথা হয় সাগর কম্পিউটার সিস্টেম নামে একটি দোকানের এক কর্মচারীর সঙ্গে। এসএসসি ও এইচএসসির সার্টিফিকেট পাওয়া যাবে কি না—জানতে চাইলে উল্টো ‘কবে প্রয়োজন’ জানতে চান দোকান কর্মচারী। উত্তরে ‘আজই’ জানালে জবাবে বলেন, ‘আজ লাগলে দুইটার জন্য তিন হাজার টাকা লাগবে। আগামীকাল নিলে দুই হাজার টাকা। এই দুইটার সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরটা যদি দেন, তাহলে কত টাকা দিতে হবে? উত্তরে তিনি বলেন, ‘পাঁচ হাজার টাকা।’ এর পর দরকষাকষির একপর্যায়ে তিনি বলেন, ‘ভাই, নেওয়ার সময় দেখা যাবে।’

এর পর কথা হয় মায়ের দোয়া উদয়ন প্রিন্টার্স দোকানের একজন বিক্রেতার সঙ্গে। কিছু বলার আগেই তিনি বলেন, ‘ভাই, কিছু লাগবে।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স সার্টিফিকেট প্রয়োজন বলার সঙ্গে সঙ্গে ওই দোকানের বিক্রেতা বলেন, ‘সার্টিফিকেট ও মার্কশিট দুটোর জন্য সাত হাজার টাকা লাগবে।’ এত টাকা অন্য কোনো দোকানে নিচ্ছে না জানালে তিনি বলেন, ‘অন্য সবার তো নরমাল কাগজ। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের মাধ্যমে ওখান থেকে টাকার বিনিময়ে আসল সার্টিফিকেটের কাগজ দেব। চার হাজার টাকার কমে হবে না।’ 

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে একটি শক্তিশালী চক্র নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেট, গাউসুল আজম মার্কেটে অবৈধভাবে জাল সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন ধরনের নথি তৈরির কাজ করে আসছে। তবে এই অবৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়টি প্রশাসনসহ অনেকে জানলেও চক্রটি থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের হুবহু সার্টিফিকেট তৈরি করে ওই চক্র। দেখে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই যে সার্টিফিকেটটি নকল বা জাল।
 
এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড দিনের চেয়ে রাতেই বেশি করা হয়। দিনে কাজের অর্ডার নিয়ে রাত ৮টায় মার্কেট বন্ধ হওয়ার পর অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে চলে সার্টিফিকেট কেনাবেচার রমরমা ব্যবসা। ৩ থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা সার্টিফিকেটে নাম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা বসিয়ে দেওয়া হয়। দেখতে হুবহু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটের মতোই। তফাৎ শুধু একটাই, ওই সার্টিফিকেটটির বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ, হল অফিস ও প্রশাসনিক ভবনে রেকর্ড নেই। 

কারা এই জাল সার্টিফিকেটের ক্রেতা 
এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে রাসেল (ছদ্মনাম) ঢাকায় এসেছেন চাকরির খোঁজে। বর্তমানে চাকরির ইন্টারভিউর জন্য বিভিন্ন জায়গায় বায়োডাটা জমা দিচ্ছেন তিনি। তবে এসএসসি সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি হচ্ছিল না তাঁর। এ পরিস্থিতিতে চাকরি পেতে অনার্সের একটা সার্টিফিকেট খুবই প্রয়োজন রাসেলের। পরে এক বন্ধুর কাছে জানতে পেরে তিনি দৌড়ান ঢাকার নীলক্ষেত এলাকায়। নীলক্ষেত এলাকার বাকুশাহ সুপার মার্কেট থেকে মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি সংগ্রহ করেন জাল অনার্সের সার্টিফিকেট। 

সজীব (ছদ্মনাম)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তিনি। অনার্স পরীক্ষা শেষ হলেও এখনো ফল প্রকাশ হয়নি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়োগ বিজ্ঞাপন দিলেও কোনোটাতেই আবেদন করতে পারছিলেন না তিনি। এর পর এক বন্ধুর পরামর্শে অনার্স পরীক্ষার একটি সার্টিফিকেটের মডেল নিয়ে হাজির হন নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটে। ওখান থেকে তিনি একটা অনার্সের সার্টিফিকেট তৈরি করেন।

যেভাবে তৈরি করা হয় সার্টিফিকেট
জাল সার্টিফিকেট থেকে শুরু করে যেকোনো ধরনের পরিচয়পত্র তৈরিতে কম্পিউটার দোকানগুলো বিশেষ কিছু পন্থা অবলম্বন করে। বিশেষ করে ফটোশপের মাধ্যমে কম্পিউটার অপারেটররা দক্ষতার সঙ্গে কাজগুলো করে থাকেন। তাঁদের প্রত্যেকের কম্পিউটারে বেশ কিছু সার্টিফিকেট ও কার্ডের মডেল রয়েছে। গ্রাহকের চাহিদামতো তাঁরা এসব মডেল দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ করেন। তাঁদের রয়েছে স্ক্যানার মেশিন, যা দিয়ে তাঁরা প্রথমে একটি মূল সার্টিফিকেট স্ক্যান করেন। এর পর এ মডেলের ওপর নাম, রোলসহ সব তথ্য পরিবর্তন করে তৈরি করেন আসল সার্টিফিকেটের আদলে একটি জাল সার্টিফিকেট। পরবর্তী সময়ে এটি সার্টিফিকেটে ব্যবহৃত কাগজের মতো এক ধরনের কাগজে প্রেসে নিয়ে ছাপানো হয়। তাঁদের সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু ছাপাখানার যোগাযোগ রয়েছে। সেখানেই তাঁরা এগুলো ছাপিয়ে থাকেন। 

এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য (ভিসি) বলেন, ‘কোনো একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এ ধরনের জালিয়াতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। নীলক্ষেতে সার্টিফিকেট জালিয়াতির বিষয়টি আমরা শুনেছি। অনেক আগে থেকেই পুলিশকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।’