আদালতে খালেদা জিয়া

ক্ষমতার অপব্যবহারে সম্পৃক্ত ছিলাম- এরূপ সাক্ষ্য কেউ দেয়নি

Looks like you've blocked notifications!

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, রাষ্ট্রপক্ষে সাক্ষীদের সাক্ষ্যে আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এতিম তহবিল সংক্রান্তে কোনোরূপ অনুদান গ্রহণের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম- এরূপ কোনো বক্তব্য কোনো পর্যায়ে কোনো সাক্ষী দেয় নাই। আমি প্রধানমন্ত্রীর এতিম তহবিল সংক্রান্ত কোনো অনুদান গ্রহণ বা বিতরণের সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম এরূপ সাক্ষ্য রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীগণের কেউই বলেন নাই।

আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ ড. আখতারুজ্জামানের আদালতে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার শুনানিকালে এসব কথা বলেন খালেদা জিয়া।

খালেদা জিয়া বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীগণের সাক্ষ্যে এটা দৃশ্যমান যে, প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল এবং স্বেচ্ছাধীন তহবিল সংক্রান্ত নথি চলমান ছিল এবং আছে। উক্ত দুটি তহবিল পরিচালনা সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্র বিজ্ঞ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীগণ দ্বারা উপস্থাপন করা হয়েছে। এই দুইটি তহবিল সংক্রান্ত যাবতীয় আবেদন নোটশিটের মাধ্যমে উপস্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট সাচিবিক দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে যথার্থ বিবেচিত হয়েছে বলে তাদের মতামত নোট আকারে নোটশিটের মাধ্যমে উপস্থাপনের পরেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে আমি তাতে আমার স্বাক্ষর দিয়েছি। এইরূপ মূল নথি এবং যাবতীয় রেকর্ডপত্র উপস্থাপন করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীগণ তা প্রমাণ করেছেন। এ বিষয়ে আমার দায়িত্ব পালনে কোনো ব্যত্যয় ঘটে নাই।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাননীয় আদালত, ইংরেজি ০৯-০৬-১৯৯১ তারিখ থেকে ২৮-০৩-২০০৭  তারিখ পর্যন্ত এই মামলার ঘটনার বিবরণ রয়েছে এবং ০৫-০৮-২০০৯ তারিখে এই মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল হয়েছে। এই ১৮ বছরের দীর্ঘ সময়কালের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পর্কে ন্যায়বিচারের স্বার্থে আপনার নিকট প্রকৃত তথ্য ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা প্রয়োজন।

খালেদা জিয়া বলেন, মাননীয় আদালত, এই মামলার এজাহারকারী মো. হারুন-অর-রশীদ পি. ডব্লিউ-১ হিসাবে অত্র মামলায় সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। তার জবানবন্দির কিছু অংশ আমাকে শুনানো হয়েছে। পি. ডব্লিউ-১ হারুন-অর-রশীদ মামলা দায়েরের পূর্বে অনুসন্ধান কার্য করেছেন বলে দাবি করেন। তিনি গত ২৫-০৬-২০০৮ তারিখ একটি অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেন। তার পূর্বে গত ১১-০৬-২০০৮ তারিখে দুদকের সহকারী পরিচালক মো. নূর আহাম্মদও একটি পূর্ণাঙ্গ অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করেন। সেই প্রতিবেদনে মো. নূর আহাম্মদ এই মামলায় আমার কোনোরূপ সম্পৃক্ততা না পাওয়ায় আমার বিরুদ্ধে তিনি কোনো মতামত প্রদান করেননি। অথচ মো. নূর আহাম্মদ কর্তৃক এইরূপ একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিলের পর সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে হারুন-অর-রশীদকে একই বিষয়ে পুনরায় অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তিনি আমার বিরুদ্ধে কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই গত ২৫-০৬-২০০৮ তারিখে একটি মনগড়া অনুসন্ধান রিপোর্ট দাখিল করেন।

বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, মাননীয় আদালত এই দুটি অনুসন্ধান রিপোর্ট পাশাপাশি পর্যালোচনা করলে আপনি দেখতে পাবেন অনুসন্ধান রিপোর্ট দুটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি কর্তৃক দাখিল হওয়া সত্ত্বেও দুটি রিপোর্টের ভাষা, বাক্য ও শব্দ চয়ন এক ও অভিন্ন। ১১-০৬-২০০৮ তারিখের রিপোর্টে সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক মো. আজিজুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়- মর্মে একটি বাক্য রয়েছে। ২৫-০৬-২০০৮ তারিখের  রিপোর্টেও সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক মো. আজিজুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়- মর্মে অনুরূপ একটি বাক্য রয়েছে। দুটি রিপোর্টের দুটি বাক্যেই ‘আজিজুল’ নামটি কেটে একই হাতে আজিজুলের ওপরে ‘মফিজুল’ নামটি বসানো হয়েছে। দুজন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা কর্তৃক দুটি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দুটি ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট দাখিল করা হলে একই হাতের লেখায় একই নাম অনুরূপভাবে কাটাকাটি কী করে সম্ভব তা আপনি বিবেচনা করে দেখবেন।

এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, সাক্ষী হারুন-অর-রশীদ কোনো নিরপেক্ষ অনুসন্ধান না করে একটি মহল কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে পূর্বের রিপোর্ট অর্থাৎ নূর আহাম্মদ কর্তৃক ১১-০৬-২০০৮ তারিখের রিপোর্টটিই হুবহু প্রিন্ট করে রিপোর্টের শেষাংশে শুধু আমার নামটি সংযোজন করেছেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা সাক্ষী হারুন-অর-রশীদ নিরপেক্ষ অনুসন্ধান না করে নিজেই দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করে একটি অসত্য রিপোর্ট দাখিল করে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন। ফলে এই সাক্ষীর সাক্ষ্য আইনের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য।

খালেদা জিয়া বলেন, মাননীয় আদালত আমার বক্তব্য হচ্ছে ১১-০৬-২০০৮ তারিখের রিপোর্টে আমার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে কোনো প্রাথমিক অভিযোগ না পাওয়ায় পিডব্লিউ-১ হারুন-অর-রশীদকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এবং বেআইনিভাবে পুনরায় অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা-২০০৭ অনুযায়ী একই ব্যক্তি কর্তৃক বারবার কিংবা একই বিষয়ে বারবার অনুসন্ধান কিংবা প্রতিবেদন দাখিলের কোনো আইনগত বিধান নাই। এই পর্যায়ে খালেদা জিয়া আজকের মতো বক্তব্য শেষ করে সময় আবেদন করেন। পরে আদালত পরবর্তী শুনানির জন্য ৩০ নভেম্বর দিন ধার্য করেন।

এর আগে খালেদা জিয়া বেলা পৌনে ১১টার দিকে তাঁর গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’ থেকে আদালতের উদ্দেশে বের হন।

খালেদা জিয়ার শুনানিতে অংশ নেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আবদুর রাজ্জাক খান, সানাউল্লাহ মিয়া, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন প্রমুখ।

এ সময় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, বিএনপির প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপপরিচালক হারুন-অর-রশিদ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়।

মামলার অন্য আসামিরা হলেন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী (পলাতক), হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান।

এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা করে দুদক।

২০১০ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের উপপরিচালক হারুন আর রশিদ। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়।

মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন—মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।