‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ শিশুদের বাড়ি

Looks like you've blocked notifications!

শনিবার দুপুর ২টা। পঞ্চমতলার ফ্ল্যাটের বাঁ পাশের কক্ষের একটি ঘরের দরজা খুলে ঢুকতেই চোখে পড়ল ঘরের চার কোনায় চারটি লোহার খাট। প্রতিটি খাটের ওপরে একটি করে শিশু, যাদের বয়স পাঁচ থেকে আট বছর, ঘুমাচ্ছে। বালিশে মাথা রাখা, হাত-পা ছড়ানো। দুপুরের খাবার খেয়ে প্রতিদিন এভাবেই ঘুমায়।

ঘরের ঠিক মাঝখানে মেঝেয় পাতানো বিছানায় একটি শিশু দুই হাত জড়িয়ে বসে আছে—কিছু একটা চিন্তা করছে। ঘরে আগন্তুক দেখে একবার তার দিকে তাকায়। আবার হয়তো কোনো চিন্তা পেয়ে বসে তাকে। সবাই ঘুমিয়ে থাকার ফলে ওর সঙ্গে কথা হয়। তার নাম নীরব (৭) (ছদ্মনাম)। দুই বছর ধরে নীরব এ বাড়িতেই রয়েছে।

স্মৃতি হাতড়ে নীরব বলে, ‘আমার বাড়ি কামরাঙ্গীরচরে। আমার মা মইর‍্যা গেছে। এর পরে বাবা বিয়ে করছে। সৎমায়ে খালি মারে। ঠিকমতো খাইতে দেয় না। বাবা রিকশা চালায়। সারা দিন বাড়িতে থাকে না। তাই বাড়ি থ্যাইকা একদিন বাইর হইছিলাম। এরপরে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা বাসে উঠছিলাম। এরপরে কই যে নামছি জানি না। এক আপায় আমারে এখানে নিয়ে আইছে।’

বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে বলে, ‘শুধু একবার বাড়িটা দেখতে যাইতে চাই। কিন্তু বাড়িতে থাকুম না। আবার এখানেই চলে আসব। বাড়ির চেয়ে এখানে ভালো।’


শুধুমাত্র নীরব নয়, নীরবের মতো ঘর ও বাবা-মা হারানো আরো অনেক শিশুকে মানুষ করছে কেএনএইচ আহছানিয়া দুঃস্থ নারী ও পরিত্যক্ত শিশু কেন্দ্র। ২৬৬/১ দক্ষিণ পাইকপাড়া, মিরপুরের একটি ষষ্ঠতলার বাসায় ২০১৫ সাল থেকে পরিত্যক্ত শিশু ও দুঃস্থ অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য এই দীর্ঘমেয়াদি নিরাপদ আবাসন ও সেবাকেন্দ্র চালু করেছে ঢাকা আহছানিয়া মিশন।

আজ শনিবার সরেজমিনে জানা যায়, সেবাকেন্দ্রের মূল কাজ হচ্ছে সমাজের নির্যাতিত নারী। যাঁরা ধর্ষণের শিকার হয়ে বা প্রতারণার শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন, যাঁদের সন্তান জন্ম দেওয়ার কোনো আশ্রয় নেই এবং সুস্থভাবে জীবন-যাপনের কোনো অবলম্বন নেই, তাঁদের জন্য এই কেন্দ্র।

আহছানিয়া দুঃস্থ নারী ও পরিত্যক্ত শিশুকেন্দ্রের ইনচার্জ উরশা (এক শব্দের নামই বলেছেন তিনি) এনটিভি অনলাইনকে জানান, মূলত পরিত্যক্ত শিশু এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের, যারা ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার, তাদের নিরাপদ ও সুরক্ষিত আবাসিক সুবিধা দেওয়াই এ প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য। তিনি জানান, একই সঙ্গে পরিত্যক্ত শিশুদের জন্য চাহিদামতো খাবার, জামাকাপড়, মাতৃস্নেহ, চিকিৎসাসেবা, কাউন্সেলিং, শিক্ষা, খেলাধুলা ও বিনোদনসহ সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করা।

উরশা জানান, এ ছাড়া পরিত্যক্ত শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে শিশুদের নিজ পরিবারে পুনর্বাসন করা বা আগ্রহী নিঃসন্তান দম্পতির কাছে হস্তান্তর করা এ কেন্দ্রের অন্যতম উদ্দেশ্য। যেসব শিশুর জন্য এমন সুযোগ তৈরি হয় না, তাদের এখান থেকে পাঁচ বছর পরে যুগোপযোগী শিক্ষার জন্য আহছানিয়া মিশন শিশু নগরীতে পুনর্বাসন করা হয়। তিনি আরো জানান, ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে সন্তান জন্ম দেওয়া মায়েদের জন্য শিশু জন্মদানের পরে তাদের আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে, যাতে করে নির্যাতনের শিকার মা যেন সমাজে সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে।


উরশা আরো জানান, তাঁরা নিয়মিত ঢাকার অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে যোগাযোগ রাখেন। একই সঙ্গে পুলিশের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার ও বিভিন্ন থানায়ও যোগাযোগ করেন। এমন কোনো ভিকটিম নারী এলে তারা তাঁকে তাদের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। আর শিশুটি জন্ম নেওয়ার আগ পর্যন্ত মাকে সব সেবা দেন।

প্রশ্নের জবাবে উরশা এনটিভি অনলাইনকে জানান, সাধারণত চেষ্টা করা হয় যে জন্ম নেওয়া শিশুটি যেন তাঁর মায়ের সঙ্গেই পরিবারে ফিরে যেতে পারে। কোনো মা যদি তাঁর সন্তানকে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে চান, তবে ওই নারীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আর তাদের বুঝিয়ে ওই শিশুসহ মাকে পরিবারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়।

পরিত্যক্ত শিশুকেন্দ্রের ইনচার্জ আরো জানান, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সন্তান জন্ম দেওয়ার পরই মা তাঁর শিশুকে রেখে চলে যেতে চান। সে ক্ষেত্রে শিশুটিকে তিন থেকে চার মাসের মধ্যেই পালক দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি জানান, জন্মের পর মা ছেড়ে চলে গেছেন এমন আটটি শিশু এখন এখানে রয়েছে। আর হারিয়ে যাওয়া বা পথশিশু ১০টি। যাদের বয়স পাঁচ বছরের বেশি, তাদের পঞ্চগড়ে আহছানিয়া মিশনের অন্য একটি কেন্দ্রে পাঠানো হয়।