প্রকৃতিকে ‘উজ্জ্বল করে ধরছেন’ তিনি!

Looks like you've blocked notifications!
বান্দরবানের রুমা খাল থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে ব্যস্ত আওয়ামী লীগ নেতা উজ্জ্বল ধরের (ইনসেটে) নিয়োগ করা শ্রমিকরা। ছবি : এনটিভি

তাঁর নাম উজ্জ্বল ধর। বান্দরবানের রুমা উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। রুমা বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতিও তিনি। বাজারে সোনার একটি দোকানও রয়েছে তাঁর।

প্রভাবশালী এ নেতা এবার রুমাকে ‘উজ্জ্বল’ করার দায়িত্ব নিয়েছেন! এ জন্য বেশ ভালোভাবে ধরেছেন উপজেলার রুমা ও সোনাই-চেমা খাল এবং এর আশপাশে থাকা প্রাকৃতিক পাথরগুলোকে। উজ্জ্বল ধর লোকজন দিয়ে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন করছেন। এই পাথর পরিবহনের জন্য আবার অবৈধভাবে পাহাড় কেটে রাস্তা বানাচ্ছেন।

উজ্জ্বল ধরের কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে খালের আশপাশের গ্রামগুলোতে। পাথর উত্তোলনের ফলে খাল ও ঝিরির ঝরনাগুলো ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আশপাশের প্রকৃতিও। শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে রুমা, সোনাই-চেমা খালকে ঘিরে গড়ে ওঠা পাহাড়ি গ্রামগুলোর লোকজন।

স্থানীয়দের অভিযোগের ভিত্তিতে সরেজমিনে দেখা গেছে, রুমা উপজেলার পলি, কোলাদি ও নাইতিং মৌজায় অনুমোদন ছাড়াই রুমা খাল ও সোনাই-চেমাখাল এবং এর আশপাশের ঝিরি, ঝরনাগুলো থেকে অবাধে প্রাকৃতিক সম্পদ পাথর উত্তোলন করছেন উজ্জ্বল ধরের লোকজন। রুমা খালের ক্যোওয়াইবওয়া পাড়া, পুনর্বাসনপাড়া, নারিকেলপাড়া ও ক্যম্বুয়াপাড়ার চারটি স্থানে এবং সোনাই খালের তিনটি স্থানে দুই শতাধিক শ্রমিক দিয়ে ১৫ দিন ধরে পাথর উত্তোলন করছেন তাঁরা। খালের পাড়ে বাঁশের বেড়া ও পলিথিন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে শ্রমিকদের থাকার ঘরও। শ্রমিকদের মধ্যে অধিকাংশই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিক। যদিও শ্রমিকদের পরিচালনাকারী মাঝিরা দাবি করছেন, তাঁরা (শ্রমিকরা) কক্সবাজারের চকরিয়া ও মহেশখালীর বাসিন্দা।

বান্দরবানের রুমা খালের ঝিরি থেকে অবৈধভাবে উত্তোলন করা পাথরের স্তূপ। ছবি : এনটিভি

এদিকে অবৈধভাবে উত্তোলন করা পাথর পরিবহনের জন্য এসকাভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে চার কিলোমিটার রাস্তাও তৈরি করা হচ্ছে।

এসকাভেটর চালক মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, ‘রুমা খাল থেকে উত্তোলন করা পাথর পরিবহনের জন্য পাহাড় কেটে ট্রাক চলাচলের রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। তেলসহ আনুষঙ্গিক সব খরচ ব্যবসায়ীদের। আমি শুধু ঘণ্টায় দেড় হাজার টাকা চুক্তিতে উজ্জ্বল ধরের কাছ থেকে চার কিলোমিটার রাস্তা তৈরির কাজটি নিয়েছি।’

রুমা খালের পুনর্বাসনপাড়ার বাসিন্দা খ্যাইসামং মারমা অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাকে না জানিয়ে উজ্জ্বল বাবু আমার জায়গায় শ্রমিক লাগিয়ে পাথর উত্তোলন করছেন। আমার সঙ্গে কোনো কথাও বলেননি, নিষেধ করার পরও তাঁরা শুনছেন না। আমি কোথায় গেলে বিচার পাব জানি না।’

উজ্জ্বল ধরের নিয়োজিত পাথর শ্রমিকদের মাঝি তপন দাশ ও মো. কাসেম বলেন, ‘চার-পাঁচটি ভাগে বিভক্ত হয়ে শ্রমিকরা পাথর উত্তোলন ও স্তূপ করে রাখার কাজ করছে। দেড় শতাধিকেরও বেশি শ্রমিক এখানে ১৫ দিন ধরে পাথর সংগ্রহের কাজ করছে। প্রতি ঘনফুট ১০ টাকা হিসেবে পাথর উত্তোলন করে স্তূপ করা হচ্ছে। রুমা খাল থেকে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার ঘনফুট পাথর উত্তোলন করা হবে।’

বোমাং সার্কেলের ৩৫৬ নম্বর পলি মৌজার হেডম্যান চিংসাঅং মারমা অভিযোগ করে বলেন, ‘ব্যবসায়ী উজ্জ্বল ধর আমার নাম ব্যবহার করে অনুমোদন ছাড়াই রুমা খাল থেকে প্রাকৃতিক পাথর উত্তোলন করছেন। পাথর উত্তোলনকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় মৌজাপ্রধানের দায়িত্বে থাকার পরও আমি কিছুই করতে পারছি না। তবে মৌজাপ্রধান হিসেবে আমি পাথর উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রশাসনকে বিষয়টি জানিয়েছি।’

বান্দরবানের রুমা খালের ঝিরি থেকে অবৈধভাবে উত্তোলন করা পাথরের স্তূপ। ছবি : এনটিভি

রুমা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শৈমং মারমা জানান, পাথর উত্তোলন ও পরিবেশ ধ্বংসের সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষরাই জড়িত। উজ্জ্বল ধর অর্থের লোভ দেখিয়ে পাথর উত্তোলনে স্থানীয় পাহাড়িদের ব্যবহার করছেন।

শৈমং মারমা বলেন, ‘পানি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। রুমা ও চেমা খাল ঘিরে অনেকগুলো পাহাড়ি গ্রামে বসতি গড়ে উঠেছে। যুগ যুগ ধরে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে বসবাস করে আসছে মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, বম জাতির লোকজন। কিন্তু পাথর উত্তোলনের দ্রুত নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে গ্রামগুলোতে। পাথর উত্তোলনের ফলে খাল ও ঝিরি, ঝরনাগুলো ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ের মানুষ ঝিরি, ঝরনা ও খালের পানি পান করে জীবন বাঁচায় এবং চাষাবাদ করে শস্য উৎপাদন করে। কিন্তু পাথর না থাকলে পানির সংকটে জীবন বিপন্ন হতে পারে। আমরা উদ্বিগ্ন। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভুগছে নিরীহ বাসিন্দারাও। কিন্তু আমরা অপারগ। চোখে দেখেও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারছি না।’

এদিকে অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের বিষয়টি স্বীকার করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি উজ্জ্বল ধর বলেন, ‘আমি একা নই। আরো অনেকে পাথর উত্তোলন করছেন। বাঙালি হওয়ায় আমার নামটি বেশি শোনা যাচ্ছে। সড়ক উন্নয়নকাজে ব্যবহারের জন্য রুমা ও চেমা খাল থেকে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। অনুমোদন কারোরই নেই।’

রুমা উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা থানছি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘পাথর উত্তোলন শাস্তিমূলক অপরাধ। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের কোনো সুযোগ নেই। পাথর উত্তোলনকারীদের কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের কারণে অনেক তথ্যই আমার অজানা। পাথর উত্তোলনকারী অসাধু ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছেন।’

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক দিলীপ কুমার বণিক জানান, ঝিরি, ঝরনা থেকে পাথর উত্তোলনের কোনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে। রুমায় পাথর উত্তোলন কাজে নিয়োজিত নয়জন শ্রমিককে আটক করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে উন্নয়নকাজের স্বার্থে কিছু পাথর উত্তোলনের অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে।