ফিরে দেখা ২০১৭
আলোচনায় ব্লু হোয়েল গেম
অনলাইনভিত্তিক ব্লু হোয়েল গেম হঠাৎ করেই বাংলাদেশে আলোচনায় আসে। গত ৫ অক্টোবর এক স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যার পর এটি নিয়ে জানাজানি হয়। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত গড়িয়েছে উচ্চ আদালত পর্যন্ত। হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) উদ্যোগ নেয় এ গেম বন্ধের।
স্বর্ণার আত্মহনন
গত ৫ অক্টোবর রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডে নিজেদের বাসা থেকে অপূর্বা বর্ধন স্বর্ণার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। সে পড়ত হলিক্রস স্কুলের অষ্টম শ্রেণিতে।
স্বর্ণার বাবা আইনজীবী সুব্রত বর্ধন জানান, মেয়ের লাশ উদ্ধারের দিনই শুনতে পান ‘ব্লু হোয়েল’ নামের একটি সোশ্যাল মিডিয়ানির্ভর গেমসের কথা। তিনি দাবি করেছিলেন, ওই গেমসে অংশ নিয়েই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তাঁর মেয়ে। সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে এ ঘটনা। নড়েচড়ে বসেন অভিভাবকরা।
স্বর্ণার পর মাদারীপুরে হাসপাতালে কিশোর
স্বর্ণার ঘটনার রেশ না কাটতেই গত ১৭ অক্টোবর মাদারীপুরে ‘ব্লু হোয়েল’ গেমে আসক্ত দাবি করা এক কিশোরকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল তার পরিবার। মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট বন্দরের ইউএস মডেল হাসপাতালে ওই কিশোরকে ভর্তি করা হয়েছিল।
ওই কিশোরের বাড়ি রাজৈর উপজেলায়। সে কেজিএস পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। তবে তার পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি পরিবারের সদস্যরা।
ঢাকার মিরপুরে ‘ব্লু হোয়েল’
মাদারীপুরে ‘ব্লু হোয়েল’ গেমে আসক্ত দাবি করা এক কিশোরকে যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, সেই দিনই ঢাকার মিরপুর এলাকায় গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া এক কিশোরের মৃতদেহের উদ্ধার করে পুলিশ। আর সেই লাশের হাতে যে ছবি আঁকা ছিল, তা দেখতে ‘নীল তিমি’র মতো।
মিরপুরের কাজীপাড়া মসজিদের পশ্চিম পাশের এক বাসা থেকে সায়েম (১৬) নামের ওই কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। সায়েম কথিত অনলাইন গেম ‘ব্লু হোয়েল’ খেলে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে বলা ধারণা করেছে তার পরিবারের সদস্যরা।
‘ব্লু হোয়েল’-এর কথা শুনেই হাত কেটেছিল এক স্কুলছাত্র!
‘ব্লু হোয়েল’ গেম খেলে নয় বরং বন্ধুদের কাছে শুনে এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গাজীপুরের শ্রীপুরে এক স্কুলছাত্র তার হাত কেটে মাছের ছবি এঁকেছিল বলে দাবি করেছিল। তার বাড়ি শ্রীপুর পৌর এলাকার বেরাইদের চালা গ্রামে। স্থানীয় স্কুলে সে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে।
এই বিষয়ে স্কুলের শিক্ষক আবদুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছিলেন, স্কুলের এক শিক্ষিকা ক্লাস নেওয়ার সময় রাকিবের বাম হাতে ব্যান্ডেজ দেখতে পান। এ কথা শুনে স্কুলের শিক্ষকরা রাকিবের কাছে গিয়ে ব্যান্ডেজের কারণ জানতে চান। জবাবে সে জানায়, ব্লেড দিয়ে নিজের হাত কেটে ব্লু হোয়েলের ছবি এঁকেছে।
হাত জখম করেছিল আরেক কিশোর
গত ১৫ অক্টোবর মুশফিকুর রহমান ইমন (১৬) নামের এক কলেজছাত্র নিজের হাত ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জখম করেছিল। পরে খবর পেয়ে পুলিশ ইমনকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ইমন বিষয়টি স্বীকার করে, হতাশা থেকে আত্মহত্যার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল সে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার জিনোদপুর গ্রামে নিজ বাড়িতেই হাত কাটা অবস্থায় ইমনকে পাওয়া যায়। ইমন ঢাকার মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল ও কলেজে পড়ছে।
ব্লু হোয়েলে আসক্ত হয়ে সর্বশেষ আরেক স্কুলছাত্রের আত্মহত্যা!
সর্বশেষ গত ৬ নভেম্বর গোপালগঞ্জের রামদিয়া বাজারে দশম শ্রেণির এক স্কুলছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়। তার নাম রাফিকুল ইসলাম পার্থ (১৬)। অনলাইনভিত্তিক গেম ‘ব্লু-হোয়েলের’ আসক্তির কারণে সে আত্মহত্যা করেছে বলে ধারণা করা হয়েছিল।
এ সময় উপপরিদর্শক (এসআই) শামিম উদ্দিন জানিয়েছিলেন, পার্থের বাম হাতে ব্লেড দিয়ে কেঁটে তিমি মাছ আঁকা ছবি রয়েছে। তা ছাড়া হাতে এফ ৫৭ এবং বুকে ক্রসচিহ্ন রয়েছে।
ব্লু হোয়েল গেম নিয়ে বিশেষজ্ঞরা যা বলেছেন
সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ‘ব্লু হোয়েল গেম’ সম্পর্কে জানতে অনেক বিশেষজ্ঞ কথা বলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক এনটিভি অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন নানা রকম সফটওয়্যার ও মেকানিজম আবিষ্কার করেছে। ফলে তরুণরা বেশি আকৃষ্ট হয়েছে। কারণ এই সফটওয়্যার ও মেকানিজমগুলোর যে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা, তার সঙ্গে তরুণদের জীবনযাপন ও বৈশিষ্ট্যগত মিল থাকায় তরুণরা বেশি আকর্ষিত হয়। অনলাইনের মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণই হচ্ছে আজকের এই ব্লু হোয়েল গেমস। এই গেমসের সঙ্গে যারা আসক্ত, তাদের আত্মহত্যার সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম না। বাংলাদেশেও এ ধরনের ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে। এ জায়গায় আমাদের অভিভাবকদের একটি শক্ত ভূমিকা পালন করার কথা রয়েছে। ১৮ বছর না হওয়া পর্যন্ত বা কলেজ পাস না করা পর্যন্ত কোনো ইন্টারনেটযুক্ত মোবাইল যেন তাদের সন্তানদের না দেন। ফোন করার জন্য কম দামি ফোন ব্যবহার করতে পারে। আর আমাদের দেশের শহরে যে অভিভাবকরা থাকেন, তাঁদের সন্তানদের স্বাধীনতার নামে যেসব সুবিধা দেন, সেগুলো কিন্তু অনেক সময় কাল হয়ে দাঁড়ায়।’
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তাফা জব্বার এনটিভি অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘এটি মূলত গেমস না, একজন ক্যাপ্টেন পেছন থেকে এটি পরিচালনা করে। এর মোট ৫০টি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। ৫০তম ধাপে গিয়ে বলা হয়, আত্মহত্যা করতে। আর প্রতিটি ধাপেই ব্যবহারকারীকে একটি করে চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়। কোনো মানুষ এ ধরনের ঘটনার শিকার হোক বা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকুক, এটা কেউ চায় না। আমাদের এখানে যে ঘটনা ঘটেছে, তার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি। আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দিয়ে যদি এটি ঢুকে, তবে জাতীয়ভাবে এর গেটওয়ে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। ভারতে এরই মধ্যে যেসব এলাকায় এর লিংক আছে, তা মুছে দেওয়া হয়েছে বা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের অবশ্যই এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। কারণ, ইন্টারনেটের গেটওয়ে সরকারের হাতে। আমরা শুধু সচেতনতা বাড়াতে পারব। এটি ব্লক করে দেওয়ার চাবি সরকারের হাতে।’
‘ব্লু হোয়েল’ গেম বন্ধের নির্দেশ
আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়া কথিত ব্লু হোয়েলসহ এ ধরনের সব গেম অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি গেমগুলো বন্ধে কেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়েছে।