প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে প্রতিবন্ধী ভাতিজাকে খুন!

Looks like you've blocked notifications!
মৌলভীবাজারে বাক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী আরিফুল ইসলাম আরিফকে (বাঁয়ে) হত্যার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন তাঁর চাচা ইয়াকুত মিয়া (ডানে) ও সহযোগী তোফায়েল আহমদ বল্লাদ। ছবি : এনটিভি

শুরুতে জানা গিয়েছিল, একটি পুকুরে থালাবাসন ধোয়াকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে প্রতিবন্ধী এক যুবক নিহত হয়েছেন। গত বছরের ২৪ জুন সন্ধ্যায় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাজীপুর এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।

ঘটনার সাত মাসের মাথায় জানা গেল, প্রতিপক্ষের আঘাতে নয়, নিজের চাচা পরিকল্পিতভাবে খুন করেছেন ওই যুবককে। আর এ কাজটি তিনি করেছেন স্রেফ প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে।

আলোচিত এই হত্যা মামলার মূল রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। গ্রেপ্তার হয়েছেন বাদীপক্ষের দুজন, যাঁরা দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন। এঁরা হলেন নিহত যুবকের চাচা ইয়াকুত মিয়া ও ইয়াকুতের সহযোগী তোফায়েল আহমদ বল্লাদ।

আজ বৃহস্পতিবার মৌলভীবাজারের পিবিআই কার্যালয়ে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেন জানান, পূর্বের শত্রুতার জের ধরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে আপন ভাতিজা বাক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী আরিফুল ইসলাম আরিফ হত্যা করেন মো. ইয়াকুত মিয়া। আর এই কাজে তাঁকে সাহায্য করে মোট চারজন। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাও উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন আছে এবং অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

প্রেস ব্রিফিংয়ে বলা হয়, গত বছরের ২৪ জুন সন্ধ্যার কিছু আগে হাজীপুর গ্রামে একটি যৌথ পুকুরে রান্নায় ব্যবহৃত থালা-বাসন ধোয়াকে কেন্দ্র করে একই বাড়ির দুই পক্ষের মধ্যে কথাকাটাকাটির জের ধরে সংঘর্ষ হয়। এ সময় উভয় পক্ষে ইট পাটকেল নিক্ষেপ হলে এতে ছয়-সাতজন আহত হয়। সংঘর্ষ থেমে গেলে আহতরা প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়।

এ ঘটনার পর সেদিন রাতেই ওই বাড়ির প্রতিবন্ধী আরিফকে গুরুতর অবস্থায় মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে যান তাঁর চাচা মো. ইয়াকুত মিয়াসহ অন্যরা। কর্তব্যরত চিকিৎসক আরিফকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ বিষয়ে আরিফের বাবা মো. আরবেশ আলী বাদী হয়ে ১৮ জনকে আসামি করে প্রথমে শ্রীমঙ্গল থানায় একটি  মামলা দায়ের করেন। শ্রীমঙ্গল থানার উপপরিদর্শক মো. জসিম উদ্দিন এ মামলার তদন্ত  করেন। তদন্ত শেষে গত ২৪ সেপ্টেম্বর ১৮ জন আসামির মধ্যে ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র পাঠান। তবে তিনজনের নাম বাদ দেওয়ার কারণে আদালতে নারাজি দেন মামলার বাদী আরবেশ আলী। পরে আদালত পিবিআইকে অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন। পরে পিবিআইয়ের তদন্তে বেরিয়ে আসে মূল ঘটনা।

নতুন তদন্তে জানা যায়, ঘটনার দিন বেলা ১১টার দিকে ওই বাড়ির কাইয়ুমের স্ত্রী সাফিয়া বেগম থালা-বাসন ধোয়ার জন্য বাড়ি সংলগ্ন যৌথ পুকুর ঘাটে যান। থালা-বাসন ধোয়ার বিষয় নিয়া সাফিয়া বেগমের সঙ্গে মো. ইয়াকুত মিয়ার চাচা মশ্বব আলীর কথা কাটাকাটি হয়। এরপর দুপুর একটার দিকে আরবেশ মিয়ার চাচাতো ভাই কালাম মিয়ার ঘরে মো. ইয়াকুত মিয়া, জুনায়েদ, বেলাল এবং তোফায়েল আহমেদ বল্লাদ বসে সিদ্ধান্ত নেন যে, মশ্বব আলী ও সাফিয়া বেগমের কথা কাটাকাটির বিষয় নিয়া আব্দুল খালেক গং ঝগড়া বাঁধালে তারা প্রতিবন্ধী আরিফুল ইসলাম আরিফ হোসেনকে হত্যা করে তাদের ফাঁসাবে।

এদিকে ওই কথাকাটাকটির ঘটনাটি সাফিয়া বেগম তাঁর পরিবারের লোকজনকে জানালে আব্দুল খালেকের ছেলে মো. সজ্জাদুর রহমান সজ্জাদ মিয়া (৩৪) বিকেলে বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে মশ্বব আলীকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করেন। এর প্রতিবাদ করেন আরবেশ মিয়া। ফলে সেই সময় দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। তখন উভয়পক্ষের লোকজন আরবেশ ও সাজ্জাদকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়।

বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ইফতারের পর সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার দিকে আরবেশ আলীর এবং আব্দুল খালিকের লোকজনদের মধ্যে ইট পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ি এবং মারামারির ঘটনা ঘটে। এতে বাদী আরবেশ আলীসহ উভয় পক্ষের কয়েকজন আহত হয়। আহতরা মৌলভীবাজার সদর হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেয়।

এই ঘটনার প্রায় আধা ঘণ্টা পর ইয়াকুত মিয়ার ঘরের সামনে বসে থাকা প্রতিবন্ধী আরিফের মাথায় একটি বাঁশের  টুকরা (গল্লা) দিয়ে বাড়ি মারেন তিনি। এতে আরিফ আহত হয়ে পড়ে যান। এরপর জুনায়েদ, বেলাল ও তোফায়েল আহমেদ বল্লাদ তিনজন মিলে আরিফ হোসেনকে ধরাধরি করে কালাম মিয়ার ঘরের বারান্দায় তুলে রাখেন। কিছুক্ষণ পর আরিফকে হাসপাতালে নেওয়ার পথে হত্যা করতে বেলাল (৩২), জুনায়েদ (২৭), মো. তোফায়েল আহমেদ বল্লাদকে নির্দেশ দেন ইয়াকুত মিয়া।

পরিকল্পনা অনুযায়ী জুনায়েদ একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা আনতে যান এবং তোফায়েল আহমেদ বল্লাদ শ্রীমঙ্গলে যান। প্রায় ৫-১০ মিনিট পর জুনায়েদ শামসুল হক নামের এক সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালককে নিয়ে আসেন। তখন জুনায়েদ ও বেলাল আহত আরিফ হোসেনকে ধরাধরি করে সিএনজিচালিত অটোরিকশার পিছনের সিটে তোলেন। এ সময় আরিফ হোসেনকে মাঝে বসিয়ে অন্য দুইজন দুই পাশে বসেন।

চালক শামসুল হক গাড়িটি চালিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন। রাত সোয়া ৮টার দিকে জুনায়েদ টেলিফোন করে তোফয়েল আহমেদ বল্লাদকে একটি দা আনতে বলেন। তোফায়েল আহমেদ বল্লাদ শ্রীমঙ্গলের পোস্ট অফিস রোডের পুরানবাজার ফুটপাতের দোকান থেকে ১৪০ টাকা দিয়ে একটি দা কেনেন। এরপর তিনি শ্রীমঙ্গল থানার রাজাপুর মেইন রোডে এসে দাঁড়ান। অটোরিকশাটি সেখানে পৌঁছলে ধারালো দা-টি জুনায়েদের হাতে তুলে দেন তোফায়েল। নিজে বসেন চালকের পাশে। এরপর তাঁরা মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেন।

অটোরিকশাটি ভৈরবগঞ্জ বাজারে পৌঁছালে জুনায়েদ চালককে মাজদিহি চা বাগানের দিকে নিয়ে যেতে বলেন। তাঁর কথামতো রাত সোয়া ৯টার দিকে চালক মাজদিহি চা বাগানের ৭ নম্বর সেকশনে যান। সেখানে আরিফকে গাড়ি থেকে নামান বেলাল ও জুনায়েদ। এ সময় উল্টো দিক থেকে একটি গাড়ি আসতে দেখে আবারও আরিফকে অটোরিকশার ভেতরে তোলা হয়। পরে অটোরিকশাটি ঘুরিয়ে প্রায় ৩০ গজ দূরে নিয়ে একটি কালভার্টের পাশে থামার নির্দেশ দেন বেলাল ও জুনায়েদ। সেখানে রাস্তার পাশে নামানো হয় আরিফকে। এরপর দুজনে মিলে আরিফের পায়ের পিছনে গোড়ালির ওপর কোপ দেন। ঘটনার সময় তোফায়েল আহমদ বল্লাদ ও চালক শামসুল হক পাশে দাঁড়িয়ে থেকে পাহারা দিচ্ছিলেন। উল্টো দিক থেকে আরেকটি গাড়ি আসতে দেখে আরিফকে আবারও অটোরিকশায় তুলে দুই পাশের পর্দা লাগিয়ে দেওয়া হয়।

বেলাল ও জুনায়েদ অটোরিকশায় উঠে আগের মতো আরিফকে মাঝখানে বসান। অটোরিকশাটি মূল সড়কে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জুনায়েদ আরিফ হোসেনের মুখ চেপে ধরেন। গিয়াসনগর পৌঁছার পর জুনায়েদ চালক শামসুল হককে ধীরে চালাতে বলেন। জুনায়েদ ও বেলাল তখন দা দিয়ে আরিফ হোসেনের মাথায় কয়েকটি কোপ দেন। এ সময়  জুনায়েদ চেপে ধরেন আরিফের মুখ এবং বেলাল চেপে ধরেন দুই পা। অটোরিকশাটি জেলা কারাগারের সামনে আসা মাত্র আরিফ জোরে ঢেকুর দিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। গ্যাস লাইটের আলোতে আরিফ মারা গেছেন বলে আসামিরা নিশ্চিত হন।

এরপর জুনায়েদ চালক শামসুল হককে অটোরিকশাটি দ্রুত হাসপাতালের দিকে নিয়ে যেতে বলেন। রাত আনুমানিক ১০টার দিকে তাঁরা মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে পৌঁছেন। সেখানে আরিফকে গাড়ি থেকে নামানো হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরের দিন ২৫ জুন সকালে বেলাল আসেন ইয়াকুত মিয়ার বাড়িতে। এ সময় পুরো ঘটনার বর্ণনা করেন তিনি। সেদিন সন্ধ্যায় ইয়াকুত মিয়া তাঁর বাড়িতে জুনায়েদের মাধ্যমে মো. তোফায়েল আহমেদ বল্লাদকে ডেকে আনেন। চারজনে মিলে প্রতিজ্ঞা করেন যে জীবনে কখনো কারো কাছে এই ঘটনা প্রকাশ করবেন না। এ ছাড়া চালক শামসুল হককে ডেকে তিন হাজার টাকা দিয়ে তাঁকেও সাবধান করে দেওয়া হয়।