জীবিত ‘পঁচাকে’ মৃত দেখিয়ে প্রতিবেদন, মামলা চলে কীভাবে?
‘পঁচা সাবানের মালিক শরীফুল আলম পঁচা এ ট্রাস্টে (জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট) টাকা দিয়েছিলেন অনুদান হিসেবে। তদন্ত কর্মকর্তা তাঁকে মৃত দেখিয়েছেন। অথচ তিনি এখনো জীবিত। এটা যে ভুয়া একটি তদন্ত, এর মাধ্যমে তা প্রমাণিত। মামলাটি তখনই খারিজ হয়ে যেত।’
আজ বৃহস্পতিবার জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় রাজধানীর পুরান ঢাকার বকশীবাজারে কারা অধিদপ্তরের প্যারেড মাঠে স্থাপিত ৫ নম্বর বিশেষ জজ ড. আখতারুজ্জামানের আদালতে তৃতীয় দিনের যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় এসব কথা বলেন আসামিপক্ষের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম।
আমিনুল ইসলাম জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্নার আইনজীবী। তবে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ারও প্যানেল আইনজীবী।
যুক্তিতর্কে আইনজীবী আমিনুল ইসলাম ‘আলমের ১ নম্বর পঁচা সাবান’ কারখানার মালিক ও আলম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফুল আলমের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। শরীফুল আলম কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সহসাংগঠনিক সম্পাদক।
এ মামলায় যুক্তি-তর্কের শুনানিতে শুরু থেকেই উপস্থিত ছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া।
আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘এখতিয়ারবিহীনভাবে এ মামলার বিচার হচ্ছে। কারণ কোনো প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত বলেনি; তাঁদের কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা আদায় করা হয়েছে। কারো বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে কোনো অভিযোগ প্রয়োজন হয়। এ মামলার কোনো অভিযোগ নেই। অভিযোগ ছাড়াই তদন্ত কর্মকর্তা মামলা করেছেন, তদন্ত করেছেন, অভিযোগপত্র দিয়েছেন, গ্রেপ্তারের ক্ষমতাও তাঁকে দেওয়া হয়েছে।’
এ সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘আপনারা এসব যুক্তি নিয়ে হাইকোর্টে গেলেন না কেন? এখন এখানে বলছেন কেন?’
আইনজীবী মোশাররফকে আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আপনি মাঝে মাঝে আওয়াজ দিবেন। আমার কথা আপনার পক্ষে গেলে আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। আর আপনি আওয়াজ না দিলে মামলা জমে না।’
আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের একটি মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁকে (ওবায়দুল কাদের) জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। এ কারণে হাইকোর্ট মামলাটি খারিজ করে দিয়েছিলেন। অথচ এ মামলায় বেগম জিয়াকে দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। কিন্তু এরপরও মামলাটি চলছে।’
আমিনুল ইসলাম আরো বলেন, ‘প্রসিকিউশন যুক্তিতে বলেছে, তারা বেগম জিয়াকে ট্রাস্টের তথ্যের জন্য পত্র দিয়েছে। বিজ্ঞ আদালত, এখানে পত্র দিবেন কেন? কারো বিরুদ্ধে তথ্য চাইলে তো নোটিশ দিতে হয়, সেই বিষয়টিও তাঁরা জানেন না। তাঁরা কিছুই করেনি।’
আইনজীবী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিজ্ঞ আদালত, আমরা বিশ্বাস করি আপনার কাছে ন্যায়বিচার পাব। আইন অনুযায়ী, মাননীয় বিচারক যেভাবে নিরপক্ষে থাকবেন, ঠিক তেমনিভাবে প্রসিকিউটর নিরপেক্ষ থাকবেন। কিন্তু উনি তো (রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী) সেটাই করেন না। আমরা মনে করি, স্বাধীন দুর্নীতি কমিশন পরাধীন হয়ে গেছে। কমিশনের একটি নিরপেক্ষ টিম থাকবে এটি স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে প্রসিকিউটর যাঁরা আছেন তাঁরা তো নিরপেক্ষ নন বরং একটি দলের পক্ষে কাজ করছেন।’
আমিনুল ইসলাম আরো বলেন, ‘আমার আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না আলাদা কোনো রায় চান না। উনি খালেদা জিয়ার অধীনে চাকরি করেছেন। তিনি (জিয়াউল ইসলাম মুন্না) বলেছেন, প্রধান আসামি যে বিচার পাবেন, আমিও সেটি পাব। আমার আলাদা কোনো ব্যাখ্যা নেই। কারণ আমি কোনো অপরাধ করিনি। আমার কোনো অপরাধ হলে সেটা প্রমাণ করার দায়িত্ব প্রসিকিউশনের।’
আমিনুল আরো বলেন, ‘আমার আসামি জিয়াউল ইসলাম মুন্না বেগম খালেদা জিয়ার অধীনে চাকরি করেছেন। তাঁর নিজস্ব কোনো স্বত্বা নেই। বেগম জিয়া যদি নির্দোষ প্রমাণিত হন তাহলে আমার আসামিও নির্দোষ।’
এরপর আদালত দুপুর দেড়টার দিকে মামলার কার্যক্রম মুলতবি করে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন।
এদিকে গ্রেপ্তার আতঙ্ক আর আদালতে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করায় নেতাদের উপস্থিতি কমে গেছে বলে দাবি করেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আদালতের প্রবেশপথে অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আবার অনেককে প্রবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি আইনজীবীদেরও প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এ কারণে আদালতের ভেতরে প্রবেশ কমে গেছে।’
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, ২০০৫ সালে কাকরাইলে সুরাইয়া খানমের কাছ থেকে ‘শহীদ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর নামে ৪২ কাঠা জমি কেনা হয়। কিন্তু জমির দামের চেয়ে অতিরিক্ত এক কোটি ২৪ লাখ ৯৩ হাজার টাকা জমির মালিককে দেওয়া হয়েছে বলে কাগজপত্রে দেখানো হয়, যার কোনো বৈধ উৎস ট্রাস্ট দেখাতে পারেনি। জমির মালিককে দেওয়া ওই অর্থ ছাড়াও ট্রাস্টের নামে মোট তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
২০১০ সালের ৮ আগস্ট জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চারজনের নামে তেজগাঁও থানায় দুর্নীতির অভিযোগে এ মামলা করেছিলেন দুদকের সহকারী পরিচালক হারুন-অর রশিদ।
ওই মামলার অন্য আসামিরা হলেন, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরীর সাবেক সহকারী একান্ত সচিব জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। এছাড়া আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণার দিন নির্ধারিত রয়েছে।