কামারুজ্জামানের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেছে আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ও বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার বিচারপতির বেঞ্চ কামারুজ্জামানের আপিল মামলার পূর্ণাঙ্গ এ রায় দিয়েছেন।
আজ বুধবার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি এখন সংশ্লিষ্ট শাখায় চলে গেছে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো জানান, রিভিউ আবেদনের জন্য ১৫ দিনের সময় থাকলেও এ সময়ের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ অপেক্ষা করবে না। ফাঁসির রায় কার্যকরের জন্য কার্যক্রম চালাবে রাষ্ট্রপক্ষ। তবে এর মধ্যে কেউ যদি রিভিউ করেন তখন রায় কার্যকর করার প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে যাবে।
এখন পূর্ণাঙ্গ রায়টি আপিল বিভাগ থেকে বিচারিক আদালত ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হবে বলে জানান মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, এরপর ট্রাইব্যুনাল মৃত্যু পরোয়ানা জারি করবেন। তারপর পরোয়ানা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে কারাগারে যাবে। পরবর্তীতে কারা কর্তৃপক্ষ বিষয়টি কামারুজ্জামানকে অবহিত করবেন। তিনি জানান, দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ইচ্ছা করলে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে পারবেন। আর ক্ষমা না চাইলে ফাঁসির রায় কার্যকর করতে আর কোনো বাধা থাকবে না।
এদিকে আসামিপক্ষের আাইনজীবী মো. শিশির মনির জানান, রায়ের সার্টিফায়েড কপি হাতে পেলে তাঁরা আসামির সাথে আলাপ করে রিভিউ পিটিশন দায়ের করবেন।
কামারুজ্জামানের মামলার রায়ে সই করা আপিল বিভাগের চার বিচারক হলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা, বিচারপতি আবদুল ওয়াহ্হাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী।
২০১৩ সালের ৯ মে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল-২। আর গত বছরের ৩ নভেম্বর জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের মতামতের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। এরপর রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা নিয়ে সৃষ্টি হয় জটিলতা। অবশেষে কাদের মোল্লার রিভিউর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর এ জটিলতার অবসান হয়। অর্থাৎ আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের ১৫ দিনের মধ্যে রিভিউ করার সুযোগ পাওয়া যাবে। অবশেষে সাড়ে তিন মাসের মাথায় প্রকাশ পেল কামারুজ্জামানের রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি।
গত বছর ৩ নভেম্বর সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ওই দিন ৫৭৭ পৃষ্ঠার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়ে শোনানো হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ মানবতাবিরোধী সাতটি অভিযোগ গঠনের মধ্যদিয়ে ২০১২ সালের ৪ জুন কামারুজ্জামানের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণত হওয়ায় দুটিতে মৃত্যুদণ্ড, দুটিতে যাবজ্জীবন ও একটিতে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।
এর আগে ২০১০ সালের ২ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানকে।
অভিযোগ, ট্রাইব্যুনালের রায় ও আপিল বিভাগের রায়
প্রথম অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ২৯ জুন শেরপুরের নালিতাবাড়িতে বদিউজ্জামানকে গুলি করে হত্যার দায়ে কামারুজ্জামানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। তবে আপিল বিভাগের রায়ে এই অভিযোগ থেকে খালাস পান তিনি।
দ্বিতীয় অভিযোগ : সে বছর ২৫ জুলাই কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে শেরপুর কলেজের ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ আব্দুল হান্নানকে মাথা ন্যাড়া করে, চুনকালি মাখিয়ে, গলায় জুতার মালা পরিয়ে চাবুক দিয়ে পেটাতে পেটাতে শহর ঘোরানো হয়। এই আচরণের দায়ে কামারুজ্জামানকে ১০ বছর কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এই দণ্ড বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
তৃতীয় অভিযোগ : নালিতাবাড়ীর সোহাগপুরে নির্বিচারে হত্যার দায়ে কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এই অভিযোগেও ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
চতুর্থ অভিযোগ : ২৩ আগস্ট গোলাম মোস্তফা তালুকদারকে মৃগী নদীর ব্রিজের ওপর গুলি করা হয় কামারুজ্জামানের নির্দেশে। তবে এই অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেওয়া মৃত্যুদণ্ডাদেশ কমিয়ে আপিল বিভাগ দেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা।
পঞ্চম অভিযোগ : শেরপুরের চকবাজার থেকে মো. লিয়াকত আলীসহ ১১ জনকে ধরে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। কামারুজ্জামান সেখানে উপস্থিত বলে রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ করলেও তা ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ করা যায়নি।
ষষ্ঠ অভিযোগ : ’৭১ সালের নভেম্বর মাসে ময়মনসিংহের জেলা পরিষদ ডাকবাংলোতে কয়েকজনকে ধরে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও তা প্রমাণ করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।
সপ্তম অভিযোগ : দারাসহ পাঁচজনকে হত্যার দায়ে কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এই রায়ও বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।