আমাদের সংস্কৃতিকে যথাযথ মর্যাদা দিতে হবে : প্রধানমন্ত্রী

Looks like you've blocked notifications!

বাঙালি জাতির গৌরবময় ইতিহাস ও কৃষ্টিকে কেউ যেন ভুলে না যায়, সে জন্য তা সংরক্ষণ এবং মর্যাদা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা জাতি, বাঙালি জাতি, আমাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আমাদের গৌরবের অনেক কিছু রয়েছে, সেইসব আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি, সেগুলো কেউ যেন ভুলে না যায়, সে জন্য এর যথাযথ মর্যাদাও আমাদের দিতে হবে।’

আজ মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে রাষ্ট্রের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক বিতরণ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।

সরকারপ্রধান বলেন, ‘জাতির পিতার যে আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল, তা ছিল জাতি হিসেবে আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্য। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অধিকার অর্জনের মধ্য দিয়েই আমরা অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে পারি। আর আমাদের সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত হতে পারে। কাজেই আমরা জাতির পিতার আদর্শ নিয়েই সব সময় এগিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলতে চাই বিশ্ব দরবারে একটা মর্যাদাপূর্ণ দেশ হিসেবে।’

প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে ২১ জন দেশবরেণ্য ব্যক্তিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ একুশে পদক-২০১৮ প্রদান করেন।

পুরস্কার হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পদক বিজয়ীদের হাতে সোনার মেডেল, সম্মাননাপত্র এবং দুই লাখ টাকার চেক তুলে দেন।

সংস্কৃতিবিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. শফিউল আলম পদক বিতরণ অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন এবং পদক বিজয়ীদের সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত পাঠ করেন। এ ছাড়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইব্রাহিম হোসেইন খান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।

অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, জাতীয় সংসদের সদস্যবৃন্দ, বিচারপতিগণ, পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অধ্যাপকবৃন্দ, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, সাংবাদিকসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশ একসময় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যে জর্জারিত ছিল। আজকে আমাদের প্রচেষ্টায় আমরা তা থেকে মুক্তি পেয়েছি।’ তিনি বলেন, যে জাতি রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা আনতে পারে, তারা কারো কাছে ভিক্ষা করে চলবে না। বিশ্ব দরবারে সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে চলবে। সেটাই আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আর সেই চেষ্টাটাই আমরা করে যাচ্ছি। এ সময় জাতীয় উৎসব পহেলা বৈশাখ উদযাপনে দেশবাসীর জন্য তাঁর সরকারের ভাতা প্রদানের প্রসঙ্গও উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের প্রতিটি অর্জনের পেছনেই কিন্তু রক্ত দিতে হয়েছে, অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। কিছুই এমনি এমনি হয় নাই।’

এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলা ১৪০০ সাল উদযাপনের সময় তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উদযাপনের অনুমতি না দিয়ে পুলিশি ঘেরাও দিয়ে রাখে। অথচ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে মিলে এই একটি দিন আমরা উদযাপন করি।’ সেই ব্যারিকেড ভেঙে প্রয়াত কবি সুফিয়া কামালকে সঙ্গে নিয়ে ট্রাকের ওপর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উৎসবের অনুষ্ঠান করার কথাও স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘পাকিস্তানের কাছ থেকে আমরা আলাদা হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করলেও ওই পাকিস্তানিদের কিছু প্রেতাত্মা এখনো এ মাটিতে রয়ে গেছে, যারা ওই প্রভুদের ভুলতে পারে না। যে জন্য আমাদের ঐতিহ্যের ওপর আঘাত আসে। ভাষার ওপর আঘাত আসে। রাজনৈতিক অধিকারের ওপর আঘাত আসে। বারবার আমাদের সংগ্রাম করতে হয়। তবে আজকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং এগিয়ে যাবে।’ ‘অন্তত নিজস্ব প্রচেষ্টায় বিশ্বে আমরা সেই মর্যাদাটা অর্জনে সক্ষম হয়েছি, যাতে কেউ আমাদের এখন আর করুণা করার সাহস পায় না, সেই মর্যাদাটা ধরে রেখেই আমাদের বিশ্বসভায় এগিয়ে যেতে হবে’, বলেন প্রধানমন্ত্রী।

সরকারপ্রধান বলেন, ‘আজকে যাঁদের আমরা এখানে পুরস্কৃত করলাম, আপনারা লক্ষ করেছেন আমাদের শিল্প-সাহিত্য, কলা থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে আমাদের অনেক রত্ন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাংলাদেশে। সেগুলো শুধু খুঁজে নিয়ে আসা এবং মর্যাদা দেওয়া। এই মর্যাদাটা দেওয়া এ কারণে যে, আমাদের আগামী প্রজন্মও যেন আমাদের এই ঐতিহ্যগুলো ধরে রাখতে পারে। আমাদের সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে পারে। আমাদের শিল্প-সাহিত্যকে ধরে রাখতে পারে, আমাদের কলাকৌশলকে ধরে রাখতে পারে এবং তারা যেন উৎসাহিত হয়।’

পদক বিজয়ীদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে যাঁরা একুশে পদক পেলেন, আমি তাঁদের আমার শ্রদ্ধা ও আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আগামীতে আমরা এভাবে আরো অনেককে মর্যাদা দিতে চাই। যেহেতু এটা একুশে ফেব্রুয়ারি, তাই আমরা বেছে ২১ জনকেই নিয়েছি। কিন্তু আমরা জানি, আমাদের আরো যোগ্য অনেকেই আছেন।’ তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে তাঁদেরও এই মর্যাদা দিতে পারবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে ১৯৫২-০-এর মহান ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে রফিক, সালাম, বরকতদের রাজপথ রঞ্জিত করার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস স্মরণ করে এই আন্দোলন গড়ে তোলার পেছনে জাতির পিতার অনন্য অবদানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেন।

তিনি বলেন, ভাষার দাবিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ‘বাংলা ভাষা দাবি’ দিবস পালনের ঘোষণা দেয়। সেই থেকেই প্রকৃতপক্ষে ভাষার দাবি রাজপথে গড়ায়। তিনি বলেন, ছাত্রলীগ ঐদিন ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস এবং অন্যান্য জায়গায় ব্যাপক পিকেটিং করে। পুলিশ ছাত্রদের লাঠিচার্জ করে এবং বঙ্গবন্ধুসহ অনেক ছাত্রকে আটক করে।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর সরকারের প্রচেষ্টায় ইউনেস্কো কতৃর্ক একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের ঘটনারও বৃত্তান্ত তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘প্রায় কুড়ি বছর আগে প্রয়াত রফিকুল ইসলাম, আবদুস সালামসহ কয়েকজন প্রবাসী বাঙালির উদ্যোগে এবং ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের আওয়ামী লীগ সরকারের প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো কর্তৃক একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আমাদের একুশ এভাবে পরিণত হয় পৃথিবীজোড়া মানুষের মাতৃভাষা দিবসে।’

অনুষ্ঠানের শুরুতে শিল্পকলা একাডেমির শিল্পীদের সহযোগিতায় সমাবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত এবং অমর একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ পরিবেশিত হয়।