নেপালে ইউএস-বাংলা বিধ্বস্ত

একসঙ্গে চিরবিদায় নিল দুই বন্ধু দম্পতি

Looks like you've blocked notifications!
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব মো. হাসান ইমাম সরকার ও তাঁর স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক হুরুন নাহার বিলকিস বানু (ওপরে)। তাঁদের বন্ধু অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী অবসরপ্রাপ্ত কলেজশিক্ষক আক্তারা বেগম। ছবি : সংগৃহীত

রাজশাহী নগরীর বরেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ আলমগীর মো. আবদুল মালেক কয়েক দিন আগে ঘুরে এসেছেন নেপাল থেকে। সে দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছিলেন বড় বোন হুরুন নাহার বিলকিস বানুকে।

৬১ বছর বয়সী বানু কিছুদিন আগে অবসর নিয়েছেন শিক্ষকতা পেশা থেকে। নাটোরের লালপুর উপজেলার গোপালপুর কলেজের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন তিনি। ছোট ভাইয়ের কাছে প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি নেপালের বর্ণনা শুনে অবসর জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে বেড়াতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন নেপালে।

হুরুন নাহার বিলকিস বানুর স্বামী মো. হাসান ইমাম সরকারের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব। সর্বশেষ চাকরি করেছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের পরিচালক পদে। গ্রামের বাড়ি দিনাজপুরে। কিছুদিন আগে চাকরি থেকে অবসরের পর স্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের বাড়ির পাশে রাজশাহী নগরীর শিরোইল এলাকার ১৭২ নম্বর বাসার ষষ্ঠতলার ‘বি’ ইউনিট ভাড়া নিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন তিনি। বিলকিস বানু ও হাসান ইমাম দম্পতির দুই ছেলে কানাডাপ্রবাসী। বড় ছেলে কায়সার ইমাম সেখানে চাকরি করেন। ছোট ছেলে তৌকির ইমাম সম্প্রতি এমএস শেষ করে পড়ালেখার পাট চুকিয়েছেন।

বিমানে উঠতে ভয় পেতেন হুরুন নাহার বিলকিস বানু। এ কারণে কানাডাপ্রবাসী ছেলেদের ডাক উপেক্ষা করেছেন একাধিকবার। বিমানে উঠতে হবে জেনেই ছেলেদের কাছে কানাডা বেড়াতে যাননি কোনোদিন। অবসরজীবনে নেপালে বেড়াতে যাওয়ার জন্য সোমবারই প্রথম উঠেছিলেন ইউএস-বাংলার বিমানে। প্রথমবারের মতো বিমানে উঠলেও স্বাভাবিকভাবে নামতে পারেননি বিমান থেকে। সোমবার নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত ইউএস-বাংলার ফ্লাইটে নিহত হন হুরুন নাহার বিলকিস বানু ও মো. হাসান ইমাম দম্পতি।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম ছিলেন মো. হাসান ইমামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রায় এক বছর আগে চাকরি থেকে এলপিআরে যান। নজরুলের স্ত্রী আক্তারা বেগম ছিলেন রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজের শরীরচর্চা বিভাগের শিক্ষক। ছয় মাস আগে তিনি এলপিআরে যান। এ দম্পতির বাড়ি রাজশাহী নগরীর উপশহর এলাকায়। নজরুল ও হাসান ইমাম এবং তাঁদের স্ত্রী চারজনই লেখাপড়া করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। ফলে এ দুই দম্পতির পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল বেশি। হাসান ইমাম দম্পতি নেপালে বেড়াতে যাচ্ছেন শুনে নজরুল ইসলাম দম্পতিও তাঁদের সঙ্গে নেপালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। গত বুধবার তাঁরা একসঙ্গে ঢাকার উদ্দেশে রাজশাহী ছেড়েছিলেন। সোমবার দুই দম্পতি একসঙ্গেই ঢাকা থেকে ইউএস-বাংলার বিমানে উড়াল দিয়েছিলেন নেপালের উদ্দেশে। পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ দুই দম্পতি সোমবার নেপালের ত্রিভুবন বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার বিমান বিধ্বস্তে একত্রেই আচ্ছন্ন হয়েছেন চিরঘুমে।

আজ মঙ্গলবার সকালে রাজশাহী নগরীর শিরোইল এলাকার হাসান ইমাম দম্পতির ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায় সুনসান নীরবতা। পড়ে আছে আসবাবপত্র, ল্যাপটপ ও সেলফভর্তি বই। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে তাঁদের ছবি। দুই ছেলের বাঁধাই করা ছবিও টানানো রয়েছে দেয়ালে।

নিহত হুরুন নাহার বিলকিস বানুর ছোট ভাই বরেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ আলমগীর মো. আবদুল মালেক বলেন, ‘আমাদের নয় ভাইবোনের মধ্যে বিলকিস আপা ছিলেন পঞ্চম। তাঁর দুই ছেলে। তাঁরা কানাডায় থাকেন। বিলকিস আপা উড়োজাহাজে চড়তে ভয় পেতেন। তাঁর দুই ছেলে মাকে একাধিকবার কানাডায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু উড়োজাহাজে ওঠার ভয়ে তিনি ছেলেদের কাছে যাননি। আমার কাছে নেপালের সৌন্দর্যের বর্ণনা শুনে এই প্রথম তিনি উড়োজাহাজে চড়ে নেপাল বেড়াতে যাচ্ছিলেন। যে উড়োজাহাজে উঠতে তিনি ভয় পেতেন, সেই উড়োজাহাজই কেড়ে নিল তাঁর প্রাণ।’

নিহত অপর দম্পতি নজরুল ইসলাম ও আক্তারা বেগমের বাসার নাম ‘কাকন কটেজ’। নগরীর উপশহর ১ নম্বর সেক্টরের এ বাসাটির নামকরণ করেছিলেন তাঁরা এক মেয়ের নামে।

আক্তারা বেগমের ভাগ্নে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা তরিকুল ইসলাম জানান, তাঁর খালা আক্তারা বেগমের দুই মেয়ে কাকন ও কনক। তাঁরা দুজনেই ঢাকায় থাকেন। তাঁদের মধ্যে কাকনের বিয়ে হয়েছে। স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় থাকেন। আর কনক লেখাপড়া করছেন। রাজশাহীর বাড়িতে খালা ও খালু থাকতেন। গত বুধবার তাঁর খালা আক্তারা বেগম ও খালু নজরুল ইসলাম নেপাল বেড়াতে যাওয়ার উদ্দেশে ঢাকায় গিয়ে মেয়ে কাকনের বাসায় উঠেছিলেন। আগামী মঙ্গলবার তাঁদের রাজশাহী আসার কথা ছিল। যাওয়ার সময় তাঁকে বাড়ি দেখাশোনা করার জন্য বলে গিয়েছিলেন।

ঢাকা থেকে মুঠোফোনে কাকন জানান, তাঁরা দুই বোন ঢাকায় থাকেন। তাঁদের বাবা-মা রাজশাহীতে থাকতেন। নেপালের বিমানবন্দরে যে বিমানটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে, তাতে তাঁর বাবা-মা ছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছেন। কিন্তু এখনো তাঁরা বিশ্বাস করতে পারছেন না। ভাবছেন, ঘরে ফিরবেন তাঁদের বাবা-মা।

নেপালে বিধ্বস্ত বিমানে আরো ছিলেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সহকারী অধ্যাপক ইমরানা কবির হাসি। তিনি এখন কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজে চিকিৎসাধীন। স্বামী প্রকৌশলী রকিবুল হাসানের সঙ্গে তিনি বেড়াতে যাচ্ছিলেন নেপালে। রকিবুলের গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার বাঘুটিয়া গ্রামে। আর হাসির বাড়ি টাঙ্গাইলে। রুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগ থেকে পাস করে সেখানেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন হাসি। তাঁর স্বামী একই বিভাগের জিরো সিক্স সিরিজের শিক্ষার্থী ছিলেন। রকিবুল ঢাকায় একটি বেসরকারি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করতেন। হাসি রাজশাহীর মুন্নাফের মোড় এলাকায় ভাড়া থাকতেন। সোমবার কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিমান বিধ্বস্ত হলে গুরুতর আহত হন হাসি ও রকিবুল হাসান দম্পতি। হাসি এখন নেপালের হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। তবে তাঁর স্বামী রকিবুল হাসান চলে গেছেন না-ফেরার দেশে।