ভৈরবে মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনা সভা

জিল্লুর রহমান ছিলেন অহিংস রাজনীতির প্রবাদপুরুষ

Looks like you've blocked notifications!
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে মঙ্গলবার নানা আয়োজনে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী পালন করা হয়। ছবি : এনটিভি

সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান মানুষের জন্য রাজনীতি করতেন। দেশের কল্যাণে রাজনীতি করতেন। তাই ঠুনকো দলীয় পরিচয়ের চেয়ে তাঁর কাছে সব সময়ই মানুষের মূল্যায়ন ছিল বেশি। রাজনীতি বা ব্যক্তি- সব ক্ষেত্রেই তিনি প্রতিহিংসাকে পরিহার করে চলতেন। তাই দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে দল-মতের ঊর্ধ্বে তাঁর একটা গ্রহণযোগ্য অবস্থান তৈরি হয়েছিল। অর্থাৎ তিনি ছিলেন দেশের অহিংস রাজনীতির প্রবাদপুরুষ। বাংলাদেশের রাজনীতির মহাত্মা গান্ধী।

মঙ্গলবার দুপুরে ভৈরবে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকীর শোকসভায় এইসব মন্তব্য করেন স্থানীয় বক্তারা। দুপুর ১২টায় দলীয় কার্যালয় চত্বরে ওই শোকসভার আয়োজন করে উপজেলা আওয়ামী লীগ। এতে আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অংশ নেয়।

সভায় সভাপতিত্ব করেন ভৈরব উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ মো. সায়দুল্লাহ মিয়া। আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, জিল্লুর রহমান কেবল অহিংস রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন নির্লোভও। ৭৫ পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মন্ত্রীত্ব এবং কারাবাস-এই দুই প্রস্তাব ছিলো তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। তিনি দ্বিতীয়টি অর্থাৎ কারাবাসকেই বেছে নিয়েছিলেন।

বক্তারা আরো বলেন, ব্যক্তি জিল্লুর রহমান কোমল হৃদয়ের অধিকারী হলেও, নীতি আর আস্থায় তিনি বরাবরই ছিলেন অবিচল, লৌহ কঠিন। যে কারণে এক এগারোর সেনাছায়ার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাধ্য হয় বৃহৎ দুই দলের প্রধানকে কারামুক্ত করে অবাধ নির্বাচন দিতে।

শোকসভায় বক্তব্য দেন কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের প্যানেল-চেয়ারম্যান, মুক্তিযোদ্ধা মির্জা মো. সুলায়মান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর আলম সেন্টু, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি এসএম বাকী বিল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক আতিক আহমেদ সৌরভ প্রমুখ।

এর আগে দিবসটি উপলক্ষে ভৈরব উপজেলা আওয়ামী লীগের আয়োজনে সকালে দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় কোরআনখানি, কালোব্যাজ ধারণ, মরহুমের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল।

এদিকে আজ জোহর ও আছরের নামাজের পর স্থানীয় বিভিন্ন মসজিদে মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনায় বিশেষ দোয়া, মিলাদ মাহফিল ও তবারক বিতরণ করা হয়। এতে দলীয় নেতাকর্মীর পাশাপাশি স্থানীয় লোকজনও অংশ নেয়।

জিল্লুর রহমান দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ২০১৩ সালের ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে মারা যান। ২০০৯ সালরে ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন।

এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার গঠন হলে জিল্লুর রহমান স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া স্বাধীনতার পর তিনি তিন বার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

১৯২৯ সালের ৯ মার্চ বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার ভৈরবপুর গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবার বলাকী মোল্লার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন জিল্লুর রহমান। জন্মের সাত মাসের মাথায় মা বাচ্চু বিবি মারা যান। আর নয় বছর বয়সে হারান বাবা স্বনামধন্য আইনজীবী, অবিভক্ত ময়মনসিংহ লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান ও জেলা বোর্ডের সদস্য মেহের আলীকে।

অনাথ ও বেদনাবিধূর শৈশবে জিল্লুর রহমান বেড়ে উঠেন দাদা হাজি মোজাফফর মুন্সী মোল্লা ও নানা-নানির আশ্রয়ে। জিল্লুর রহমান ১৯৪৫ সালে ভৈরব কেবি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান ঢাকা কলেজ) থেকে আইএ পাস করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৪ সালে এমএ পাস করেন। ১৯৫৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন।

মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে জিল্লুর রহমানের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জিল্লুর রহমান সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলায় ১৯৫২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি এক ছাত্র সমাবেশে জিল্লুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। সেখানেই ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারিতে ফজলুল হক ও ঢাকা হলের পুকুরপাড়ে যে ১১ জন নেতার নেতৃত্বে ২১ ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সেখানে জিল্লুর রহমান অন্যতম নেতা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন।

ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার অপরাধে জিল্লুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন এবং একই সঙ্গে তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রি কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু ছাত্রদের প্রবল আন্দোলনের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুনরায় তাঁর মাস্টার্স ডিগ্রি ফিরিয়ে দেয়। তিনি ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৬ সালে জিল্লুর রহমান কিশোরগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। ষাটের দশকে তিনি ঢাকা জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র থাকাকালে সিলেটে গণভোটের কাজ করার সময় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন।

১৯৬২ সালের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি গণআন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশে থেকে জিল্লুর রহমান অংশগ্রহণ করেন। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি ভৈরবের জনগণের কাছে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। সে সময় থেকেই তাঁর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে উঠতে থাকে ভৈরবের মানুষের কাছে। তৎকালীন ভৈরব অঞ্চলের প্রতিটি দেয়ালে দেয়ালে তাঁর নাম প্রচার হতে থাকে।

১৯৭০ সালে জিল্লুর রহমান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি মুজিবনগর সরকার পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা এবং জয় বাংলা পত্রিকার প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় দখলদার পাকিস্তান সরকার তাঁর সংসদ সদস্য পদ বাতিল করে ২০ বছর কারাদণ্ড প্রদান ও তাঁর সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহচর হিসেবে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ৭৫ পরবর্তী দেশের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম ও ক্রান্তিলগ্নে তাঁর ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জিল্লুর রহমান ছিলেন দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে সমভাবে গ্রহণযোগ্য। আর তাই তিনি ভৈরব-কুলিয়ারচর আসন থেকে ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভানেত্রী এবং ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দলীয় জনসভায় গ্রেনেড হামলায় আহত হয়ে ২৪ আগস্ট মৃত্যুবরণকারী শহীদ আইভি রহমান তাঁর স্ত্রী ছিলেন। তাঁদের সন্তান নাজমুল হাসান পাপন বর্তমানে স্থানীয় সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি।