গৃহবধূকে গণধর্ষণ, সালিসের পর স্বামীর আত্মহত্যা

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় এক গৃহবধূ গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এই ঘটনায় সমাজপতিরা গ্রামের অভিযুক্ত দুই যুবককে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন এবং গলায় জুতার মালা পরিয়ে গ্রাম ঘোরান। ওই বিচারে ক্ষুব্ধ হয়ে গৃহবধূর স্বামী আত্মহত্যা করেছেন।
গত বুধবার সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নে এই সালিস ও আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় ধর্ষণের শিকার গৃহবধূর বাবা ১৭ জনকে আসামি করে দুটি মামলা করেছেন। একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে, অপরটি আত্মহত্যার প্ররোচনার অপরাধে। পুলিশ বৃহস্পতিবার ধর্ষণে অভিযুক্ত অমল সরকার (৩৫) ও রাজীব তালুকদার (২৪) এবং সালিসকারী কৃপাসিন্দু তালুকদার (৭০), কাজল তালুকদার (৩৫), জয়ন্ত সরকার (৩২), রফিকুল ইসলাম (৪৮) ও ফকর উদ্দিনকে (৬০) আটক করেছে।
ধর্ষণের শিকার গৃহবধূ বৃহস্পতিবার সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, মঙ্গলবার তাঁর শাশুড়ি বাড়িতে ছিলেন না। স্বামী অন্যান্য দিনের মতো মঙ্গলবার রাতে হাওরে মাছ ধরতে চলে যান। তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। এর মধ্যে কোনো একসময় ঘরের দরজা খুলে গ্রামের অমল সরকার ও রাজীব তালুকদার ঘরে ঢুকে তাঁর মুখ ও হাত বেঁধে ধর্ষণ করে। পরদিন ভোরে তাঁর স্বামী বাড়িতে এসে তাঁকে মুখ ও হাত বাঁধা এবং নিস্তেজ অবস্থায় পান। স্বামী মুখের কাপড় খোলার পর তিনি সব কিছু খুলে বলেন।
এরপর গৃহবধূর স্বামী বিষয়টি ওই দুই যুবকের অভিভাববকদের জানিয়ে বিচার দাবি করেন। কিন্তু অভিভাবকরা উল্টো মিথ্যা রটনা দিচ্ছেন বলে হুমকি দেন। পরে গৃহবধূ তাঁর বাবা ও ভাইকে ফোন করে গ্রামে আনান। তাঁরা আসার পর বুধবার বিকেলে গ্রামে সালিস বসে।
গৃহবধূ বলেন, ‘সালিসে কী হয় আমি জানি না। সালিসের পর আমার স্বামী আমাকে ধরে কান্নাকাটি করে বলেন, আমি যেন বাবার সঙ্গে কয়েকদিন গিয়ে থেকে আসি। আমি না করেছিলাম তবুও তিনি আমাকে অনুরোধ করে পাঠান। স্বামীর বাড়ি থেকে বিকেল ৪টায় রওনা দিয়ে আমি গিয়ে বাড়ির দরজায় পা দিতে পারিনি। খবর পেয়েছি স্বামী ফাঁস লেগে আত্মহত্যা করেছে। এখনো আমি আমার স্বামীর লাশ দেখিনি।’
গ্রামবাসী ও পুলিশ জানায়, গৃহবধূ ধর্ষণের বিষয়টি জানাজানি হলে বুধবার গ্রামে সালিস বসে। এ সময় অমল ও রাজীবকে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। এবং গলায় জুতার মালা ও টিন বেঁধে সারা গ্রাম ঘোরানো হয়। সালিসের ওই রায়ে সন্তুষ্ট হননি গৃহবধূর স্বামী। বিচারের পর পরই স্ত্রীকে বাবার বাড়ির লোকজন নিয়ে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় নিজ বসতঘরে আত্মহত্যা করেন তিনি। প্রতিবেশী ধিরাজ সরকার টেপন তাঁর লাশ ঝুলতে দেখে গ্রামবাসীকে জানান। পরে গ্রামবাসী পুলিশকে বিষয়টি জানান।
এদিকে গৃহবধূর স্বামীর আত্মহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায় অমল সরকার। এ সময় গ্রামের লোকজন রাজীব তালুকদারকে আটকে রাখলেও পরে প্রভাবশালী লোকদের সহায়তায় সেও পালিয়ে যায়।
খবর পেয়ে পুলিশ বুধবার রাত ১১টায় গৃহবধূর স্বামীর লাশ উদ্ধার করে। এ সময় পুলিশ পৈণ্ডুপ গ্রাম থেকে কৃপাসিন্দু তালুকদার, কাজল তালুকদার, জয়ন্ত সরকার, জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী ইউনিয়নের হরিনাকান্দি গ্রামের রফিক মিয়া ও ফকর উদ্দিনকে আটক করে। বৃহস্পতিবার ভোরে পালিয়ে যাওয়ার পথে জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার হালীর হাওর থেকে রাজীব তালুকদার ও ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর থানার নগদাপাড়া গ্রাম থেকে অমল সরকারকে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন স্থানীয় লোকজন।
এদিকে বৃহস্পতিবার সদর হাসপাতালে নিহতের লাশের ময়নাতদন্ত ও তাঁর স্ত্রীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়।
তাহিরপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল্লাহ বলেন, অভিযুক্ত অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে পুলিশ।
পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ বৃহস্পতিবার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি বলেন, গৃহবধূকে গণধর্ষণ ও তাঁর স্বামীর আত্মহত্যার ঘটনাটি বিশেষ নজরে দেখা হচ্ছে। থানায় পৃথক দুটি মামলা রেকর্ড হয়েছে। দুই ধর্ষকসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়া দুই মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে, সবাইকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রফিকুল ইসলাম জানান, নিহত ব্যক্তির লাশের ময়নাতদন্ত এবং তাঁর স্ত্রীর ডাক্তারি পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। আগামী সপ্তাহে ডাক্তারি পরীক্ষার প্রতিবেদন দেওয়া হবে।