‘খুন হওয়ার পরও মামলার আসামি’
‘নিজ ঘরে ফেরার সময় আমার স্বামী আশরাফ মীর ও ভাই ইসহাক গাজীকে খুন করা হয়েছে। তাঁদেরকেই আবার মামলার আসামি বানিয়েছে পুলিশ। যে পুলিশের সাহায্য চেয়েছিলাম সেই পুলিশই আমাদের স্বজনদেরও আসামি করে এলাকা জনশূন্য করে ফেলেছে।’
আজ সোমবার দুপুরে সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ করেন গত ২৪ আগস্ট চিংড়িখালিতে নিহত আশরাফ মীরের স্ত্রী ফজিলা খাতুন। এ সময় নিহত ইসহাক গাজীর স্ত্রী ফরিদা খাতুনসহ দুই পরিবারের আত্মীয়স্বজন ও ভূমিহীন নারী পুরুষরা উপস্থিত ছিলেন। ফজিলা খাতুন দাবি করেন, ১২ বছর ধরে কালিগঞ্জের চিংড়িখালিতে বাস করছেন তাঁরা।
অভিযোগ রয়েছে, গত ২৪ আগস্ট ভোরে খাসজমি দখলের সময় দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে আশরাফ মীর, তাঁর শ্যালক ইসহাক গাজী ও সহযোগী আবুবকরকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয় প্রতিপক্ষ। কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পর আশরাফ ও ইসহাক মারা যান। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছে। এসব মামলায় ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১২ জনকে। ঘটনার পর থেকে গ্রেপ্তার আতঙ্কে ওই এলাকার লোকজন বাড়ি ছেড়ে গেছে।
নিহত আশরাফ মীর ব্যাংক ডাকাতিসহ দুটি মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ২৪টি মামলা রয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে ফজিলা খাতুন ও ফরিদা খাতুন অভিযোগ করেন, গত ১ মার্চ চিংড়িখালি থেকে সন্ত্রাসের মুখে ১২০টি ভূমিহীন পরিবারকে উচ্ছেদ করে দেয় আবুল হোসেনের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা। এরপর থেকে তারা পথে পথে ঘুরছিলেন। গত ১৯ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে একটি আবেদন করে আশরাফ মীর নিরাপত্তা দাবির পাশাপাশি ওই জমিতে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে প্রশাসনের সহায়তা চান। মন্ত্রী এ ব্যাপারে পুলিশকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়ার পাঁচ দিনের মাথায় এই জোড়া খুনের ঘটনা ঘটে।
লিখিত বক্তব্যে নিহত আশরাফ মীরের স্ত্রী ফজিলা খাতুন বলেন, ‘আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পুলিশের সহায়তা চেয়ে গত ২৪ আগস্ট চিংড়িখালি বৈরাগীরচকে যাই। এ সময় সেখানে থাকা সন্ত্রাসীরা ওই দুজনকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও ভারি জিনিস দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে। এতে আহত হন অনেকেই।’ এ সময় ফজিলা খাতুন হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতার ছবি দেখান।
ফজিলা খাতুন আরো বলেন, ‘এই হত্যার পর কালিগঞ্জ থানায় মামলা দিতে গেলে পুলিশ তা গ্রহণ করেনি। উল্টো পুলিশ বাদী হয়ে যে দুটি মামলা করেছে তাতে আসামি করা হয়েছে নিহত আশরাফ মীর ও তাঁর শ্যালক ইসহাক গাজী এবং তাঁদের আত্মীয়স্বজনদের। এমনকি হত্যায় বাধা দিতে যাওয়া কয়েকজন আহত হওয়ার পরও তাদের আসামি করা হয়েছে।’
মামলায় পুলিশ প্রকৃত হত্যাকারীদের আড়াল করেছে বলে অভিযোগ করেন আশরাফ ও ইসহাকের স্বজনরা। তাঁরা বলেন, দুই মামলার প্রতিটিতে ৬৬ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৫০০ নারী-পুরুষকে আসামি করায় পুলিশ আতঙ্কে ভূমিহীনরা এখন বাড়ি ফিরতে পারছে না।
এর আগে বৈরাগীরচকে ২০০৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ছবিরন নেসা, ২০০৬ সালের ২৫ মে আবুল হোসেন সরদার ও একই বছর কবির সানাসহ তিন ভূমিহীন নেতা খুন হন। আশরাফ মীর ও ইসহাক গাজীকে নিয়ে শুধু চিংড়িখালি বৈরাগীরচক ভূমিহীন আন্দোলনে প্রাণ দিলেন পাঁচজন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সন্ত্রাসী আবুল হোসেন ও তাঁর সহযোগীরা চিংড়িখালি বৈরাগীরচক থেকে প্রকৃত ভূমিহীনদের উচ্ছেদ করে সেখানে মাছের ঘের করার পাঁয়তারা করেছেন। তাঁরা আশরাফ মীরের ছেলের একটি ঘেরও দখল করে নিয়েছেন। এরই মধ্যে চিংড়িখালি ও বৈরাগীরচকে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের বসিয়ে সরকারের খাস জমি দখলে নিয়েছে আবুল হোসেন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসীরা।
চিংড়িখালির ওই খাস জমি জরিপ করে ভূমিহীনদের মাঝে বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। এর আগেই জামায়াত-বিএনপি আশ্রিত সন্ত্রাসীরা ভূমিহীনদের নেতা আশরাফ মীর ও তাঁর শ্যালক ইসহাক গাজীকে হত্যা করে সরকারের উদ্যোগটিকে ভণ্ডুল করে দিল বলে মন্তব্য করেন আশরাফ মীরের স্ত্রী।
জোড়া খুনের বিচার দাবি করে ফজিলা খাতুন বাদী হয়ে আদালতে ৮৬ জনকে আসামি করে একটি অভিযোগ দিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন নিহত আশরাফ মীরের দুই ছেলে হাসান মীর ও মো. হাসানুজ্জামান, হাসনের স্ত্রী পারভিন সুলতানা, পরিবারের সদস্য ও ভূমিহীন ফিরোজা খাতুন, সুজন গাজী, ইসমাইল গাজী, সাথী বেগম, আলেয়া খাতুন, মহম্মদ আলী, হামিদা খাতুন, ফাতেমা বেগম, তাসলিমা খাতুন, ফরিদা বেগম, রহিমা খাতুন, কুলসুম বেগম, তানজিলা খাতুন, মেহেরুন নেসা, জাহানারা বেগম, খায়রুন নেসা, সফি বিশ্বাস প্রমুখ।