প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

‘ওই আইনের কিছু শব্দ সংজ্ঞায়িত করা উচিত’

Looks like you've blocked notifications!
গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। ছবি : এনটিভি

প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল ২০১৮ প্রসঙ্গে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘আমরা যে আইনটা করতে চাই সেটা সারা দেশের জন্য করতে চাই। কোন গোষ্ঠি বা পেশার জন্য আইন করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।’

ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল, ২০১৮ সম্পর্কে আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ডাক টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণাণয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সঙ্গে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন আইনমন্ত্রী।

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বৈঠকে ৮টি ধারা বিশেষ করে ১৫, ২১, ২৫, ২৮, ২৯ ,৩১, ৩২ এবং ৪৩ নিয়ে আলাপ আলোচনা হয়েছে। সেখানে যেকথাগুলো ওঠে আসছে তা হল- বৈঠকে আমরা একমত হয়েছি ওই আইনের কিছু শব্দ সংজ্ঞায়িত করা উচিত।’

আইনমন্ত্রী উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘প্রস্তাবিত আইনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু সেটা বলতে কি বুঝায়- এটি কিন্তু সাংবাদিকদের প্রস্তাবনায় পরিস্কার উল্লেখ আছে। এরকম আটটি ধারা নিয়ে এডিটরস কাউন্সিল, বিএফইউজে এবং এ্যাটকোর নেতৃবৃন্দ সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। যেসব শব্দ এই আইনের মধ্যে আনা বা ঢুকানোর প্রয়োজন সেগুলো আমরা করার সুপারিশ করব।’

আনিসুল হক বলেন, ‘সংসদীয় কমিটি এই আইনটি চূড়ান্ত করার পর আবার এই সাংবাদিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে বসা হবে।’

আসন্ন বাজেট অধিবেশনেই এই আইনটি পাস হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাব আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এটা আমার হাতে না। বাজেট অধিবেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশন। এই অধিবেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছাড়া সাধারণত কোনো আইন পাস হয় না। এই অধিবেশন বাজেট নিয়ে আলোচনার জন্য। তাই আমি এরকম কথা বলতে পারব না এটা এই অধিবেশনেই পাস হবে।’

অপর এক প্রশ্নের জবাবে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘৫৭ ধারা অপব্যবহার রোধে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশের সেল থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত অনুমোদন পাওয়া না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত মামলা রজু হবে না। এটা করার পরে ৫৭ ধারায় মামলা শতকরা ৯৫ ভাগ হ্রাস পেয়েছে। এই আইনটা যখন হবে তখন নিশ্চয়ই ৫৭ ধারা বাতিল হবে।’

বৈঠক শেষে দৈনিক সমকালের সম্পাদক গোলাম সরওয়ার সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংসদীয় কমিটির সাথে অত্যন্ত ফলপ্রসু আলোচনা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যেসব বাধা রয়েছে সেগুলো দূর করার ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছি।’

দি ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮টি ধারার ব্যাপারে আপত্তি জানানো হয়েছে। স্বাধীন সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হয় এমন দুঃশ্চিন্তার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে, তারা সেগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে শুনেছেন এবং গ্রহণ করেছেন।’

মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আমরা আশা করছি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আমূল পরিবর্তন আসবে। এই আইনের বড় একটি দুর্বলতা হচ্ছে সংজ্ঞার অস্পষ্টতা। এসব অস্পষ্টতা দূর করে কোন কোন বিষয় স্পষ্টীকরণের কথা বলা হয়েছে, আইনমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এ ব্যাপারে সম্মত হয়েছেন।’

এক প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আনাম বলেন, ‘তাঁরা আমাদের বারবার আশ্বস্ত করেছেন যে, এই আইনের দ্বারা কোনভাবেই স্বাধীন সাংবাদিকতা ব্যাহত হবে না। সংবিধান অনুযায়ী সাংবাদিকদের জন্য যে অধিকার রয়েছে তা নিশ্চিত করা হবে।’

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (একাংশু) সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘আমরা দুটি দিক নিয়ে আলোচনা করেছি, একটি হলো- এমন কোন আইন প্রণয়ন না করা করা, যাতে সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিঘ্নিত হয়, আরেকটি হচ্ছে- গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত হয় এমন কোন ধারা যাতে আইনে না থাকে। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে আইনের ৮টি ধারা সম্পর্কে বিস্তারিত মতামত তুলে ধরা হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সাংবাদিক সমাজ চায় যে, ডিজিটাল অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি আইন হবে এবং এই আইনটির যাতে অপপ্রয়োগ না হয়। এই আইনটি সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে প্রয়োগের ব্যাপারে যাতে প্রেস কাউন্সিলকে যুক্ত করা হয় এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ও গুপ্তচরবৃত্তিকে যাতে এক করে দেখা না হয়।’

অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনার্স (অ্যাটকো) প্রেসিডেন্ট সালমান এফ রহমান বলেন, ‘আইনের যেসব অসুবিধাগুলো রয়েছে এগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। সংসদীয় কমিটিসহ সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন এবং প্রস্তাবিত আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে বলে আশ্বস্ত করেছেন।’

অ্যাটকোর ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বেসরকারি টিভি চ্যানেল ‘একাত্তর’ এর প্রধান নির্বাহী মোজাম্মেল বাবু বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে, গনমাধ্যমকে বাধাগ্রস্ত করা বা গণমাধ্যমের সংবাদ প্রচারে বাধাগ্রস্ত করা নয়, বরং স্যোসাল মিডিয়ার নামে আনিয়ন্ত্রিত গুজব নির্ভর মিডিয়ার হাত থেকে মূল ধারার গণমাধ্যমকে প্রটেকশন দেয়ার জন্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। এসব আইনের অস্পষ্টতার কারণে গণমাধ্যমকর্মীদের ধারণা হতে পারে যে, সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে, ওইসব জায়গাগুলোতে কমিটির সবাই স্পষ্টীকরণের ব্যাপারে ঐক্যমতে এসেছেন।’ তিনি বলেন, ‘অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ব্যাপারে যে সংশয় তৈরি হয়েছিল সেটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, বলা হয়েছে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এর আওতায় পড়বে না। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দাবৃত্তির যে সংজ্ঞা রয়েছে এর আওতায় এটিকে নিয়ে আসা হবে, যাতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কিছুতেই বাধাগ্রস্ত না হয়।’

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে মোজাম্মেল বাবু বলেন, ‘অনেকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের নামে উসকানি দিয়ে রামুর মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। সুতরাং এখানে ধর্মীয় অনুভূতির আঘাতের সাথে ধর্মীয় উসকানির বিষয়টিকেও যাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার অবমাননাকেও অপরাধের আওতায় আনার ব্যাপারে বৈঠকে ঐক্যমত হয়েছে।’

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সাংবাদিকদের বলেন, ‘বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে যেসব প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়েছে এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। এ ব্যাপারে সংসদীয় কমিটি এবং সংশ্লিষ্ট সকলেই একমত হয়েছে যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ডিজিটাল অপরাধ দমন করার জন্য, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করা বা সাংবাদিকদের জন্য কোন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার জন্য এই আইন তৈরি করা হয়নি।’

মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘উভয় পক্ষ আজ একমত হয়েছে যে, এ ধরনের একটি আইন করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই আইনের যে যে ক্ষেত্রে সংশোধন করা প্রয়োজন রয়েছে সেসব জায়গায় সংশোধন করা হবে। সংবিধানে প্রদত্ত মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ করার বা বাধাগ্রস্ত করার ইচ্ছা নিয়ে এই আইন প্রণয়ন করা হয়নি।’

কমিটির সভাপতি ইমরান আহমদের সভাপতিত্বে কমিটির সদস্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, শওকত হাচানুর রহমান (রিমন), কাজী ফিরোজ রশীদ, হোসনে আরা লুৎফা ডালিয়া এবং বিএফইজে’র মহাসচিব ওমর ফারুক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।