সংসদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা লতিফ সিদ্দিকীর

Looks like you've blocked notifications!
টাঙ্গাইল-৪ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে নিজের বক্তব্য শেষ করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ছবিটি বিটিভি থেকে নেওয়া

জাতীয় সংসদে নিজের বক্তব্য শেষ করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। আজ মঙ্গলবার রাত পৌনে ৮টার দিকে এই ঘোষণা দেন তিনি। এ সময় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর কাছে নিজের পদত্যাগপত্রও জমা দেন তিনি।urgentPhoto

জাতীয় সংসদে দেওয়া শেষ বক্তব্যে সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘আমি মানুষের জন্য রাজনীতি করেছি, মানুষকে ভালোবেসেছি। আমি অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছি। আজ আমার সমাপ্তির দিন। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই। যদি কারো মনে আঘাত দিয়ে থাকি তাহলে আমি দেশবাসীর কাছে নতমস্তকে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি।’

এর আগে নিজের বক্তব্যের শুরুতে নিজেকে ‘সাচ্চা মুসলমান’ বলে দাবি করেন লতিফ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘আমি মানুষ বলেই ভুল ভ্রান্তি আছে। কিন্তু মানবতার প্রতি বিশ্বাস হারাই না। ধৈর্য হারাই না। রাষ্ট্র নিপীড়ন করল, আমি ধৈর্য ও সহনশীলতার সঙ্গে মেনে নিয়ে তা মোকাবিলা করলাম। মাননীয় স্পিকার আমি অভিযোগের টুকরি মাথায় নিয়ে সংসদে দাঁড়াইনি। ভালোবাসার মহিমা বিতরণ করতে, সৌহার্দ্য আর প্রীতি ভালোবাসার মালা সাজিয়ে নিয়ে এসেছি।

আমি সবসময় ধূসরতাবিরোধী। শঠতা, কপটতা, স্বার্থপরতা, সুযোগ সুবিধার পথ হাঁটাকে অপছন্দ করি। জীবন উৎসর্গ করেছিলাম মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র ও মানবতার সেবায়। নিজের জন্য ভারী ভারী পদ-পদবি করায়ত্ত করতে নয়।

আর পদ-পদবির জন্য নিজের চরিত্র কলুষিত ও কালিমালিপ্ত করা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। আমি আলোর পথের যাত্রী। মানুষকে আলোর পথে চালিত করাই আমার জীবনধর্ম।’

ধর্ম নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমি সাচ্চা মুসলমান। ধর্মীয় জীবন একান্তই আমার জীবন। এই জীবন ধারণ নিয়ে কুণ্ঠা নেই আমার। নিজের কাছে নিজেই জবাবদিহি করে সতুষ্ট। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমার ধর্ম কুঠুরির ভাবজগৎ নিয়ে সমষ্টিতে আলোড়ন-আন্দোলন দেখা দিয়েছে। সমষ্টি আমাকে ত্যায্য করেছে।’

ব্যক্তি জীবন একান্তই ব্যক্তির মন্তব্য করে সাবেক এই মন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমাকে ষড়যন্ত্রকারী, প্রতিশোধ পরায়ণ, ধর্মদ্রোহী গণদুশমন ও শয়তানের রিপ্রেজেনটেটিভ সাজাতে ধর্মকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানো হয়েছে। আমি স্পষ্ট করে দৃঢ়চিত্তে বলতে চাই, আমি ধর্মবিরোধী নই। আমি ধর্ম অনুরাগী, একনিষ্ঠ ও সাচ্চা মুসলমান। আমি বলতে সাহস পাই, ধর্মীয় অনুশাসনের নামে যেসব গর্হিত কাজ ধর্মান্ধ ও মৌলবাদী জনগোষ্ঠি স্বার্থ চরিতার্থ করতে তৎপর তাদের বিরুদ্ধে শান্তির ধর্ম, ন্যায়ের ধর্ম, সত্যের ধর্ম ইসলামের সঠিক তাৎপর্যকে তুলে ধরতে অম্লান থাকবে আমার পথচলা।’

আমার মনোভঙ্গির প্রচার ও প্রকাশ নিয়ে যতই মিথ্যাচার হোক, যত আঘাত হোক, তা মোকাবিলা করব আমি।

আমি মনে করি হজ প্রতিপালন ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে অন্যতম ফরজ। এই ফরজ পালন আর কতগুলো অবশ্য পালনীয় ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিপালন করে মাত্র একবারই করার কথা। যা আমি নিজেও করেছি। মাননীয় স্পিকার ওয়াজেব-সুন্নত পরিহার করে, অন্যান্য অবশ্য পালনীয় ফরজ তরফ করে যারা এই ফরজটি পালনে প্রতিবছর ব্যস্ত তাদের মানসিকতা আর আমার বিবেচনা ভিন্ন। হজ যে একটা বিরাট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড তা কিন্তু মানতে না চাইলে মিথ্যা হয়ে যায় না।’

এ সময় নিজের রোজা ও ধর্ম পালনের কথা বলেন লতিফ সিদ্দিকী। তিনি আরো বলেন, ‘যতবার বলতে হয় ততবার বলব, তাবলিগকারীরা যদি ধর্ম প্রচারের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্র চেতনা বৃদ্ধির দিকে মনোযোগী হতেন তাহলে, তাবলিগের যে প্রভাব আমাদের সমাজ জীবনে প্রতিফলিত তা আরো কার্যকর ভূমিকা রাখত। নবী করিম (স.) কখনো জীবনকে অস্বীকার করে ধর্ম পালন করতে বলেননি। জীবনের জন্য ধর্ম অপরিহার্য।ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে বিদায় হজের ভাষণে মহানবী (স.) নিষেধ করে গেছেন।’

তাঁর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ কতটুকু যৌক্তিক সে বিচার অনাগত কাল করবে বলে মন্তব্য করেন এই সংসদ সদস্য। এ সময় সংবিধানের বহিষ্কার সংক্রান্ত কয়েকটি অনুচ্ছেদ বর্ণনা করেন তিনি। তাকে পাঠানো চিঠিতে সংসদের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ ও সংবিধানের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে বলেও দাবি করেন লতিফ সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘বিনা শুনানিতে এভাবে সংসদ সদস্যের আসন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়া যথাযথ কি না সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।’

সবশেষে তিনি বলেন, ‘আমি আর কথা বাড়াতে চাই না ... আমি মানুষের ভালোবাসাকেই আমার শ্রেষ্ঠ মূলধন বলে মনে করি। আমার নেতার অভিপ্রায় আমি আর সংসদ সদস্য না থাকি। কর্মী হিসেবে আমি নেতার একান্ত অনুগত ছিলাম। বহিষ্কৃত হওয়ার পর তার ব্যত্যয় সমীচীন মনে করি না। আমি দ্বিধাহীন কণ্ঠে কারো বিরুদ্ধে কোনো ঘৃণা-বিদ্বেষ না নিয়ে কোনো অভিযোগ উত্থাপন না করে হৃষ্টচিত্রে জাতীয় সংসদের আসন ১৩৩, টাঙ্গাইল ৪, সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করছি।’ 

গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে টাঙ্গাইল সমিতি আয়োজিত অনুষ্ঠানে পবিত্র হজ ও তাবলিগ জামাত নিয়ে কটূক্তি করেন তৎকালীন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। এর পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে তাঁর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে মোট ২১টি মামলা আমলে নেওয়া হয়। এর আগে মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে তাঁকে অপসারণ করা হয়।

গত জুলাইয়ে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের পর আবদুল লতিফ সিদ্দিকীকে এ বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য চিঠি দেয় নির্বাচন কমিশন। পরে ২ আগস্ট নির্বাচন কমিশনের চিঠির জবাব পাঠান লতিফ সিদ্দিকী। চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, সংসদ সদস্যপদ বাতিলের বিষয়ে শুনানি করতে নির্বাচন কমিশনের কোনো এখতিয়ার নেই। কেননা, তিনি এখনো আওয়ামী লীগের একজন সমর্থক। দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করলেও তিনি নিজে দল থেকে পদত্যাগ করেননি বা অবসর নেননি। জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ভোট দেননি, তাই সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন হয়নি।

আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্যপদ বাতিল প্রশ্নে ২৩ আগস্ট নির্বাচন কমিশনে শুনানি হয়। শুনানি শেষে লতিফ সিদ্দিকী সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এ বিষয়ে শুনানি স্থগিত করার অনুরোধ করেছি। আমার পদত্যাগপত্রটি স্পিকারের কাছে জমা দেব। আমি বুঝতে পেরেছি, আমার নেতা চান না আমি এ নিয়ে আর আইনি লড়াই করি। আমি নেতার ভক্ত, তাঁর আদেশ মেনে আমি আর আইনি লড়াই করব না।’

শুনানির ঘটনার ৯ দিন পর লতিফ সিদ্দিকী আজ পদত্যাগপত্র জমা দেন।