বাবার হাতে পানি পান করেই চোখ বন্ধ করে মুক্তামনি

Looks like you've blocked notifications!

শেষবারের মতো বাবার কাছে পানি চেয়েছিল বিরল রোগে আক্রান্ত সাতক্ষীরার শিশু মুক্তামনি। বাবার হাতে পানি পান করেই না ফেরার দেশে চলে গেল সে।

আজ বুধবার সকাল সোয়া ৮টার দিকে সাতক্ষীরার নিজ বাড়িতে মারা যায় মুক্তামনি।

মৃত্যুর আগে সবকিছু স্বাভাবিক থাকলেও কিছুই খেতে পারছিল না মুক্তামনি। গায়ে ছিল প্রচণ্ড জ্বর।

মুক্তামনির বাবা ইব্রাহীম হোসেন বলেন,‘কথা বলতে পারতেছিল না। তো আমারে বলতেছে যে,আব্বু আপনি এইদিকে আসেন। বলল আমারে একটু পানি দেন। পানি দিলাম। মারা গেল ।’

মুক্তামনির শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে তার বাবা বলেন,‘এমনি আল্লাহর রহমতে ভালো ছিল। একদম স্বাভাবিক মতো ছিল। শুধু একটু,তেমন কিছু খাচ্ছিল না। প্রায় সারা রাত ওর আম্মু আমি ওইখানে ছিলাম। সব চেষ্টার পরও হলো না। মারা গেল আজকে সকালে। আপনারা সবাই আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ ডাক্তারসহ বিশ্বের যে যেখান থেকে আমার মেয়ের এই নিউজটা দেখছেন সবাই আমার মেয়ের প্রতি খুবই আন্তরিক ছিল। এবং সবাই প্রাণ খুলে আমার বাচ্চার জন্য দোয়া করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময় ডাক্তারদের ফোন দিয়ে বলতেন যে বাংলাদেশের সর্বোত্তম চিকিতসা দেন। আল্লাহর ইচ্ছা ছিল, আসলে এই পর্যন্তই আমার বাচ্চার আয়ু ছিল।’

মেয়ের মৃত্যুতে অবিরাম কেঁদে চলেছেন মুক্তামনির মা। জানতে চাইলেও কোনো কথা বলতে পারছিলেন না তিনি।

সাতক্ষীরার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক শাহ আবদুল সাদী বলেন,‘রুহের মাগফিরাত কামনা করছি, জেলা প্রশাসন সাতক্ষীরার পক্ষ থেকে। শুধু সাতক্ষীরাই নয় মুক্তামনি আসলে সারা দেশের। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বিরল রোগে সে আক্রান্ত ছিল। সব ধরনের প্রচেষ্টা, সহানূভূতি মায়া মমতাকে ব্যর্থ করে দিয়ে মুক্তামনি পবিত্র রমজান মাসে পরলোক গমন করেছেন। আমরা এই শিশুর জন্যে দোয়া করি। মহান আল্লাহ তাকে বেহেশত নসিব করুন।’

সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা.ফরহাদ জামিল বলেন,‘অবস্থা ভালো ছিল না মেয়েটার। ক্ষতটা বেড়ে গিয়েছিল, তার জ্বর ছিল। রক্তস্বল্পতাও কিছুটা ছিল। রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা আমরা নিতাম। ঢাকা থেকে সামন্তলাল স্যার আমাদেরকে বলছিলেন যে, আপডেট কী, কী অবস্থা? স্যারকে সরাসরি ফোন দেই, স্যার বলেন যে আমি মুক্তামনির আব্বার সঙ্গে কথা বলব। সকাল পর্যন্ত এটাই ছিল। সকাল বেলা মুক্তামনির আব্বা আমাকে ফোন দিল। দিয়ে বলতেছেন যে, জ্বর তো কমতেছে না। কী করা যায়। আমি একটি ঔষধের একটু পরিবর্তন করে দেই। তার পনের মিনিট পরেই সিভিল সার্জন স্যার ফোন দিয়ে বলেন যে, মারা গেছে।’

মুক্তামনির পরিবার জানায়,জন্মের দেড় বছর পর মুক্তামনির দেহে একটি ছোট মার্বেলের মতো গোটা দেখা দেয়। এরপর থেকে সেটি বাড়তে থাকে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়েও কোনো চিকিৎসা হয়নি। তার আক্রান্ত হাতটি গাছের গুঁড়ির আকার ধারণ করে  প্রচণ্ড ভারি হয়ে ওঠে। এক সময় এতে পচন ধরে,পোকাও জন্মায়। দিন রাত চুলকানি ও যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে থাকত  মুক্তামনি। বিকট দুর্গন্ধের কারণে আত্মীয়স্বজন ও পড়শিদের যাতায়াতও এক রকম বন্ধ হয়ে যায়।

অনেক ডাক্তার ও হাসপাতালে মুক্তামনির চিকিৎসা করিয়ে কোনো লাভ হয়নি। অবশেষে দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো মুক্তার করুণ চিত্র তুলে ধরে। পরে সরকারি উদ্যোগে মুক্তামনিকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে।

চিকিৎসকরা বায়োপসি করে জানান,মুক্তামনির রক্তনালিতে টিউমার রয়েছে। পরে সিঙ্গাপুরে তার চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু ভিডিও কনফারেনসের মাধ্যমে দেখার পর সিঙ্গাপুর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মুক্তার চিকিৎসায় তাদের অস্বীকৃতির কথা জানিয়ে দেয়। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তামনির চিকিৎসার দায়িত্ব নেন। তিনি সরকারি খরচে মুক্তামনির চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

২০১৭ সালের ১০ জুলাই মুক্তামনিকে ভর্তি করার পর থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের দুই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. আবুল কালাম আজাদ ও ডা. সামন্তলাল সেনের নেতৃত্বে একটি মেডিকেল টিম টানা ছয় মাস চিকিৎসা দেয়। এ সময় তার দেহে কয়েক দফা অস্ত্রোপচার করা হয়। চিকিৎসায় তার স্বাস্থ্যের উন্নতিও হয়।

ঢাকায় টানা ছয় মাস চিকিৎসা শেষে এক মাসের ছুটিতে মুক্তামনি ২০১৭ সালের ২২ডিসেম্বর বাড়ি ফিরে আসে। এরপর থেকে ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী বাড়িতে রেখে তার চিকিৎসা চলতে থাকে। এরই মধ্যে মক্তামনির অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। পরে আজ সকালে মারা যায় সে।