মাকে ফেলে আলাদা বাসায় থাকতে চাননি, তাই খুন

Looks like you've blocked notifications!
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ফারুকুল ইসলাম (বাঁয়ে) ও তাঁর সম্বন্ধি ইউনুস হোসেন সুজন। ছবি : এনটিভি

মাকে ফেলে স্ত্রীর সঙ্গে আলাদা বাসায় থাকতে না চাওয়ার কারণেই খুন হতে হয়েছে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ফারুকুল ইসলামকে।

গতকাল সোমবার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) কার্যালয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেন সংবাদ সম্মেলনে এমনটাই জানান।

এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী শিরিন আক্তার, তাঁর মা মালেকা বেগম ও বড় ভাই মো. ইউনুস হোসেন সুজনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। ইউনুস হোসেন সুজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও শিরিন আক্তার জামিনে ও মালেকা বেগম পলাতক রয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে মো. শাহাদাত হোসেন জানান, প্রায় তিন বছর ভালোবাসার সম্পর্কের পর বিয়ে করেছিলেন ফারুকুল ও শিরিন আক্তার। তাঁদের একটি দুই বছরের মেয়েও আছে।

বিয়ের পর থেকেই নিহত ফারুকুল ইসলাম স্ত্রী শিরিন আক্তার ও মা জয়না বেগমকে নিয়ে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। কিন্তু শিরিন আক্তার চাইছিলেন না যে, ফারুকুলের মা তাঁদের সঙ্গে থাকুক। এছাড়াও বিভিন্ন পারিবারিক কারণে ফারুকুলের সঙ্গে শিরিন আক্তারের মতবিরোধ দেখা দেয়। এসব নিয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে অনেকবার সালিশ বৈঠকও হয়।

একপর্যায়ে ফারুকুল তাঁর স্ত্রী শিরিন আক্তার ও মেয়েকে নিয়ে বিরামপুর সুরভীপাড়া রহিম লন্ডনীর বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করেন। কিন্তু মাকে ছাড়া আলাদা থাকাটা মেনে নিতে পারছিলেন না ফারুকুল।

তাই ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ফারুকুল আবার ভাড়া বাসা ছেড়ে মায়ের কাছে নিজ বাড়ি নোয়াগাঁও সাকিনে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি শিরিন আক্তার। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়াও হয়।

একপর্যায়ে শিরিন আক্তার, তাঁর মা মালেকা বেগম ও ভাই মো. ইউনুছ হোসেন সুজনকে দিয়ে ফারুকুলকে বুঝানোর চেষ্টা করে। কিন্তু ব্যর্থ হন।

পরে ওই মাসের ৭ তারিখে সকাল ১০টায় ইউনুস হোসেন সুজন ও মালেকা বেগম ফারুকুলের বাসায় আসেন। এ সময় বাসা ছেড়ে দেওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হয়। কিন্তু বাসা ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন ফারুকুল।

একপর্যায়ে ইউনুছ হোসেন সুজন ফারুকুলকে গলা চেপে ধরে দেয়ালের পাশে থাকা সেলাই মেশিনের ওপর আছাড় মারেন ও ঝাপটে ধরে ফারুকুলের মুখে তিন-চারটি ঘুষি মারে। এ সময় তিনি আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে স্ত্রী শিরিন আক্তার, তাঁর হাতে থাকা স্টিলের ট্রে দিয়ে তাঁকে দুই-তিনটি আঘাত করেন।

এরপর ইউনুস হোসেন সুজন প্রথমে সেলাই মেশিন উপরে তুলে ফারুকুলের মুখের ওপর ছুড়ে মারেন। এছাড়া রান্নাঘরের খালি গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে তাকে আঘাত করেন সুজন।

ক্রমাগত আঘাতের কারণে মাথা ও মুখ থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই ফারুকুল মারা যান। এই পুরো সময় তাদের ছোট মেয়ে সামনেই বসে ছিল।

পরে এই হত্যাকে ভিন্ন খাতে নিতে দুই ভাই-বোন মিলে ফারুকুলকে মেঝেতে শুইয়ে তার ওপর বিছানার আসবাবপত্র, সোফার কুশনসহ অন্যান্য আসবাবপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখেন। আর এই পুরো ঘটনার সময় আসামি শিরিনের মা মালেকা বেগম বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন।

এরপরে শিরিন আক্তার নিজের মা ও ভাইকে নিরাপদে চলে যেতে গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসেন।

পরে বাসার মালামাল সরাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় স্বামী মারা গেছেন বলে চিৎকার করেন শিরিন। এ ঘটনায় নিহত ফারুকুল ইসলামের মা জয়না বেগম শ্রীমঙ্গল থানায় ছেলে হত্যার দায়ে শিরিন আক্তারসহ (২৫) দুই-তিনজনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) মো. কামাল উদ্দিন মামলার একমাত্র আসামি শিরিন আক্তারকে অভিযুক্ত করে গত ৩১ অক্টোবর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

মামলার বাদী ওই প্রতিবেদনে আদালতে না-রাজি দাখিল করলে আদালত তাঁর আবেদন গ্রহণ করে আরো তদন্তের জন্য অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পিবিআই মৌলভীবাজারকে নির্দেশ দেন।

এ আদেশ অনুযায়ী গত ১ মার্চ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পিবিআইয়ের পরিদর্শক মুহাম্মদ শিবিরুল ইসলামকে তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

পরে গত ৩০ মে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ বিশ্বরোড থেকে শিরিন আক্তারের ভাই ইউনুছ হোসেন সুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাঁকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার স্বীকারোক্তি দিয়ে তিনি হত্যার বর্ণনা দেন।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ফারুকুল সিএনজি পাম্প স্টেশনের মেকানিক ছিলেন। এছাড়া তাঁর একটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেট কার ছিল। মাইক্রোবাসটি  তিনি ভাড়া খাটাতেন এবং প্রাইভেটকার নিজে চালাতেন। স্ত্রীর পরিবার অসচ্ছল থাকায় তিনি অর্থসহ অন্যান্য সহযোগিতার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছিলেন। সম্বন্ধি ইউনুছ হোসেন সুজনকে শায়েস্তাগঞ্জ জিএস ব্রাদার সিএনজি ফিলিং স্টেশনে নজেলম্যান হিসেবে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন।