মাছের ভাণ্ডারে মাছ নেই

Looks like you've blocked notifications!
কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর লঞ্চঘাটের মাছের আড়তের অল্প কিছু মাছ। ছবি : এনটিভি

‘মাছের দেশে মাছ নেই, জেলের পেটে ভাত নেই’- এমন অবস্থায় বিরাজ করছে হাওরাঞ্চলের প্রবেশপথ বলে খ্যাত কিশোরগঞ্জের ভৈরব-কুলিয়ারচরে। বিগত কয়েক বছরে আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে মিঠাপানির মাছের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত কিশোরগঞ্জের বিশাল হাওরাঞ্চলসহ এখানকার নদী-নালার স্বাদুপানির দেশীয় মাছ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে চাহিদা বাড়লেও ক্রমেই কমে আসছে মাছের জোগান।

ফলে বাজারে মাছের দুষ্প্রাপ্যতাহ দাম চলে যাচ্ছে ক্রেতা-সাধারণের নাগালের বাইরে। তাই ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ বহুল প্রচলিত প্রবাদটি কেবল জায়গা করে নিচ্ছে বইয়ের পাতায়। অন্যদিকে এ অঞ্চলে বংশ পরম্পরায় মাছ শিকারের ওপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীরা প্রয়োজনীয় মৎস্য আহরণ করতে না পারায় বাধ্য হচ্ছে মানবেতর জীবনযাপনে।

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কার্প হ্যাচারির মাছ। ছবি : এনটিভি

তবে স্থানীয় মৎস্য বিভাগের অভিমত, মুক্তজলাশয় অর্থাৎ নদী-নালার মৎস্য সম্পদ কমে এলেও বৃদ্ধি পাচ্ছে বদ্ধ জলাশয়ে মাছের আবাদ। জিহ্বার স্বাদ কমে এলেও পুষ্টির কোনো ঘাটতে হবে না এখানকার অধিবাসীদের।

বড় নদ-নদী ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, কালী, গোড়াউত্রাসহ অসংখ্য হাওর-বাওর, নালা, খাল-বিল আর পুকুরে ভরা কিশোরগঞ্জের বিশাল হাওরাঞ্চলসহ ভৈরব-কুলিয়ারচর এক সময় মাছের ভাণ্ডার বলে পরিচিত ছিল। ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের সহজ লভ্যতা ও প্রাচুর্য্যতা ছিল এখানে। খেতে খুব স্বাদ হওয়ায় এখানকার মাছের কদর ছিল পুরো দেশব্যাপী। কিন্তু যতই সময় পার হচ্ছে এখানকার মাছের ভাণ্ডারের শূন্যতা দেখা দিচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেকগুলো প্রায় বিলুপ্তির পথে।

স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জানায়, বর্তমানে আগের তুলনায় চারভাগের একভাগ মাছও নেই নদী-নালা আর খাল-বিলে। তাই তারা সারাদিন শিকার করেও এক-দেড়শ টাকার বেশি মাছ শিকার করতে পারে না। মাছ না থাকায় বাড়ির ঘাটে সারাদিন অলস বাঁধা থাকে তাদের মাছ শিকারের নৌকাগুলো। দ্রব্যমূল্যের এ অসহনীয় বাজারদরে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। অন্য কোনো উপায় না থাকায় এ পেশায় লেগে আছে বলেও জানায় জেলেরা।

জলের মাছ কমে যাওয়ায় ভালো নেই ডাঙ্গার মৎস্যজীবী পরিবারগুলো। এখানকার কয়েক হাজার মৎস্যজীবী পরিবার তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে নিদারুণ কষ্টে মানবেতর জীবন যাপন করছে।

ভৈরবের নয়াহাটি জেলেপল্লীর বিসা চন্দ্র বর্মণ (৭০), সুরেশ বর্মণ (৭০), তরণি বর্মণ (৬০) ও অরুণ চন্দ্র বর্মণ (৫০) এবং মহেশপুরের জালাল উদ্দিন (৭৫), সাদির মিয়া (৬৫), হরলাল দাস (৬০) ও অরিত্র লাল দাস (৬২) জানান, তাঁরা তাঁদের শৈশবে দেখেছেন পানির ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ভেসে বেড়াত। এখন সেই দৃশ্য কল্পনায়ও ভাসে না!

তারা আরো জানান, আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগেও এক ঘণ্টা জাল টানলে এক-দেড় মণ মাছ উঠত জালে। এখন দিন-রাতেও এর সিকি ভাগও হয় না। এর মাঝে আবার মরার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো আছে জলডাকাতদের উৎপাত। নদীর একটু গভীরে গেলেই ডাকাতরা ছিনিয়ে নেয় জাল এমন কি নৌকাটি পর্যন্ত। তাই ডাঙ্গার কাছাকাছি থেকেই যেটুকু মাছ শিকার করা যায়, তাই নিয়েই তাদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়। এগুলো দেখারও কেউ নেই বলে অভিযোগ জেলেদের।

এদিকে কুলিয়ারচরের জেলে সুচিন্দ্র বর্মণ (৭৫), পীযূষ চন্দ্র দাস (৬২) ও নিতাই চন্দ্র দাস (৭২) জানান, নদ-নদীতে এমনিতেই মাছ নেই। তার ওপর আবার প্রভাবশালীদের জুলুম-অত্যাচার তাঁদের সহ্য করতে হয়। প্রভাবশালী মহল মাঝ নদীতে বাঁধ দিয়ে এবং পাটিজাল পেতে মাছ শিকার করে। তাদের ধারে কাছেও যেতে পারে না জেলেরা।

জলে মাছ নেই। আড়ৎগুলোতে মাছের আমদানি কম। ব্যবসা নেই। তাই নেই মুনাফা। ফলে মৎস্য ব্যবসায়ীদেরও দিন-কাল ভালো নেই। জানালেন কুলিয়ারচর মৎস্য আড়তের মৎস্যজীবী ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শহিদ মিয়া। বহু প্রজাতির মাছ এখানকার নদ-নদী, খাল-বিল থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় মাছের সরবরাহ কমে গেছে।

আগের তুলনায় চারভাগের একভাগ মাছও এখন এখানকার আড়ৎগুলোতে আমদানি হয় না বলে জানালেন মৎস্য ব্যবসায়ী মো. ইয়াকুব মিয়া ও হাজি মুর্শিদ মিয়া। তাঁরা জানান, তাঁদের এখন পথে বসার মতো অবস্থা হয়েছে। একেকজন ৪০-৪৫ বছর যাবত মাছের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। মাছের এমন আকাল এই অঞ্চলে তাদের চোখে আর পড়েনি। দিন যতই যাচ্ছে, দেশীয় মাছের সংকট আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে বলে দাবি তাঁদের।

ভৈরব সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কুমার পাল নদী-নালায় মাছ কমে যাওয়ার জন্য প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কতোগুলো সুনির্দিষ্ট কারণকে তিনি দায়ী করেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, কল-কারখানার বর্জ্য, জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়া, মাছের আবাসস্থল বিনষ্ট হয়ে যাওয়া, সেচে মাছ ধরে ফেলা এবং ছোট ফাঁসের জালসহ নানা ধরনের অবৈধ জাল ব্যবহার করা।

মুক্তজলাশয়ের মাছ রক্ষায় মৎস্য কর্মকর্তা প্রজনন মৌসুমে জেলেদের মাছ ধরা থেকে বিরত রাখা, অভয়াশ্রম সৃষ্টি, পানি সেচে মাছ ধরা বন্ধ, পানি দূষণ প্রতিরোধ, ছোট ফাঁসের জালসহ কারেন্টজাল ব্যবহার বন্ধ করার কথা জানান। পাশাপাশি সমাজের স্টেকহোল্ডারদের বেশি সচেতনতা আশা করেন।

জলাশয়ে মাছ নেই। কিশোরগঞ্জের ভৈরবে অলস সময় কাটাচ্ছেন এক জেলে। ছবি : এনটিভি

এদিকে কুলিয়ারচরের সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জেলেদের দরিদ্রতা দূরীকরণের লক্ষ্যে মৎস্য বিভাগের নেওয়া নানা উদ্যোগের কথা জানালেন। তিনি জানান, এরই মধ্যে এই অঞ্চলের জেলেদের নিবন্ধন সম্পন্ন করা হয়েছে। তাদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পালনসহ তাদের খাদ্য সহায়তা প্রদানের জন্য মৎস্য বিভাগ কাজ করে যাচ্ছে।

জাহাঙ্গীর আলম আশাবাদ ব্যক্ত বলেন, অচিরেই হয়তো এর কার্যক্রম শুরু হবে। এছাড়া মৎস্য আইন বাস্তবায়ন, উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছের পোনা ছেড়ে মাছের উৎপাদন বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছে এই বিভাগ।

প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছের উৎপাদন কমে গেলেও, বদ্ধজলাশয়ে অর্থাৎ চাষের মাছের উৎপাদন বেড়েছে বলে জানালেন সরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কার্প হ্যাচারির কর্মকর্তা মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক। তিনি জানান, এখানকার উৎপাদিত উন্নতমানের রেনুপোনায় পুকুর মাছ চাষের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। এ ছাড়া বিলুপ্ত মাছগুলোর বংশ বৃদ্ধি করা হচ্ছে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে। এতে করে মাছের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে বিশ্বে মাছ উৎপাদনে আমাদের তৃতীয় স্থানের অবস্থান অব্যাহত থাকবে। এবং মাছ রপ্তানিতে আমাদের অবস্থান করা চতুর্থস্থান থেকে আমরা হয়তো দ্বিতীয়-তৃতীয় স্থানে উন্নীত হয়ে যেতে পারি। এসব আশাবাদ এই হ্যাচারি কর্মকর্তার।