‘বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরাতে চেষ্টা করছে সরকার’

Looks like you've blocked notifications!

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত দুই খুনি নুর চৌধুরী ও রাশেদ চৌধুরীর অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পরও তাঁদের ফিরিয়ে আনতে পারছে না সরকার। নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছেন। সেখানে মৃতুদণ্ড নিষিদ্ধ, ফলে দেশটি নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছে না। অপরদিকে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

গত সোমবার আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক খুনিদের মধ্যে চারজনের অবস্থান সম্পর্কে সরকারের কাছে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই। বাকি দুজনের একজন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন; তাঁকে ফিরিয়ে আনার আলাপ-আলোচনা চলছে। আদালতের আশ্রয় নেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

আনিসুল হক বলেন, আমি কোনো সময় নির্ধারণ করে দেব না। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু এটা এখন খুব কঠিন হয়ে গেছে। আমেরিকারটা অতটা না, কানাডারটা কঠিন হয়ে গেছে। সে জন্যই আমরা অনেক রকম পন্থা অবলম্বন করছি- আইনিপন্থা, আলাপ-আলোচনার পন্থা। এগুলো চালিয়ে যাচ্ছি।

২০১০ সালের জানুয়ারিতে আদালতের রায় কার্যকরের পর বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয় উল্লেখ করে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘অন্য এক কাজে কানাডা সফরে গিয়ে সেখানকার আইনমন্ত্রীর সঙ্গে নূর চৌধুরীকে ফেরতের বিষয়ে আলোচনা হয়। তবে আলোচনা করে বুঝতে পেরেছি, যেহেতু সে আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে এবং কানাডা মৃত্যুদণ্ড রহিত করেছে, তাই তাঁকে ফেরত আনার ক্ষেত্রে জটিলতা আছে।’

‘তবে দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একক সিদ্ধান্তে বাণিজ্যিক আইনি পরামর্শক সংস্থা নিয়োগ করেছে। অথচ এখানে আমাদের প্রয়োজন ছিল সাংবিধানিক আইনে বিশেষায়িত একটি পরামর্শক সংস্থার’, যোগ করেন আইনজীবী।

জানা যায়, ১৯৭৬ সালের ৮ জুন প্রকাশিত এক সরকারি প্রজ্ঞাপনের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের সবাইকে বিভিন্ন দূতাবাসে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে সৈয়দ ফারুক রহমান ও খন্দকার আবদুর রশীদ ছাড়া বাকিরা চাকরির প্রস্তাব গ্রহণ করেন।

নুর চৌধুরী ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ১৯৭৬ সালে তিনি ইরানের বাংলাদেশ দূতাবাসে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। পরে আলজেরিয়া ও ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং হংকংয়ের কনসুলেটে বদলি হন তিনি। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি হংকংয়ে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল ছিলেন। ১৯৯৬ সালের জুনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিনি কূটনৈতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। ওই বছরই তিনি কানাডায় গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। কানাডার রাজধানী টরন্টোর ১৩ কিলোমিটার উপকণ্ঠ ইটোবিকোকে তিনি এখন অবস্থান করছেন।

রাশেদ চৌধুরী ১৯৭৬ সালে জেদ্দায় বাংলাদেশ কনসুলেটে দ্বিতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। পরে তিনি কেনিয়া, মালয়েশিয়া, জাপান ও ব্রাজিলে বাংলাদেশ দূতাবাসে কাজ করেন। ১৯৯৬ সালের জুলাইয়ে তাঁকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাশেদ চৌধুরীকে ওই বছরের জুলাইয়ে দেশে ফেরার নির্দেশ দেওয়া হলে তিনি ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো চলে যান। ১৯৭৬ সালে বেইজিংয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিব হিসেবে নিয়োগ পান শরিফুল হক। ১৯৮২ সালে হংকংয়ের কনস্যুলেটে বদলি হয়ে সেখানে তিনি ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। হংকং থেকে ওই বছরই তাঁকে কেনিয়ায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে বদলি করা হয় এবং ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদে দায়িত্ব পালন করেন।  

মামলার প্রক্রিয়া

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর খুনিদের বিচারের উদ্যোগ নেয়। দায়মুক্তি আইন বাতিলের পর ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল মামলার রায়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। নিম্ন আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বিভক্ত রায় দেন। রায়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম রুহুল আমিন ১৫ আসামির ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। খালাস দেন পাঁচ আসামিকে। অপর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ১৫ আসামির সবার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন।

নিয়ম অনুযায়ী, ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। খালাস দেন তিনজনকে।

আসামিদের আবেদনের পর ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ পাঁচ আসামির আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন।

এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট আপিল শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি ওই বছরের ৫ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করেন। আপিল শুনানির জন্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন ওই বছরের ৪ অক্টোবর বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ গঠন করেন। শুনানি শেষে ১৯ নভেম্বর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন। এরপর আসামিদের করা পুনর্বিবেচনার আবেদনও ২৭ নভেম্বর খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।  

ওইদিন রাতেই পাঁচ খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান ও মহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ রায় কার্যকরের আগে ২০০১ সালে একজন আসামি আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মারা যান।

বাকি ছয়জন পলাতক রয়েছেন। এরা হলেন- এম রাশেদ চৌধুরী, নুর চৌধুরী, খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, আব্দুল মাজেদ ও মোসলেহউদ্দিন খান।

প্রাণভিক্ষায় যা বলেছিলেন কর্নেল ফারুক

রিভিউ আবেদন খারিজের পর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যতম আসামি কর্নেল (অব.) ফারুক রহমান রাষ্ট্রপতির কাছে ইংরেজিতে লেখা আবেদনে তিনটি কারণ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, প্রথমত, তাঁর অবর্তমানে তাঁর বৃদ্ধ মা মাহমুদা রহমানকে দেখার কেউ নেই। দ্বিতীয়ত, তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার পর দেশ পুনর্গঠনে কাজ করেছেন এবং তৃতীয়ত, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য তিনি দুঃখিত। কারা কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে ওই আবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও সেটি নাকচ হয়ে যায়।