প্রেম নিয়ে বিবাদ, থানা হেফাজতে যুবকের মৃত্যু

Looks like you've blocked notifications!
পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থানা প্রাঙ্গণে আজ সোমবার নিহত হাসানুর রহমান মিলনের (ইনসেটে) মা হাসিনার বিক্ষোভ। গেটের বাইরে উত্তেজিত এলাকাবাসী। ছবি : এনটিভি

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থানা হেফাজতে হাসানুর রহমান মিলন (২০) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী দেবীগঞ্জ থানা ঘেরাও করেছে। লাশ থানা থেকে লুকিয়ে ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়ায় দেবীগঞ্জ চৌরাস্তায় মহাসড়ক অবরোধ করে তারা।

এ ঘটনায় মিলনের পরিবার অভিযোগ করেছে, তাঁকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। অন্যদিকে মিলন থানার শৌচাগারে গলায় কম্বল পেচিয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে পুলিশ দাবি করেছে। 

আজ সোমবার বেলা ১১টা থেকে সোয়া ১১টার মধ্যে থানাহাজতে মিলনের মৃত্যু হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে। মিলনের বাড়ি দেবীগঞ্জ উপজেলার পৌরসভার থানাপাড়া এলাকায়। তিনি ওই এলাকার হবিবর রহমানের ছেলে।

থানাহাজতে মিলনের মৃত্যুর ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে ওই এলাকার শত শত বিক্ষুব্ধ বাসিন্দা থানা ঘেরাও করে পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। একপর্যায়ে পরিবারের সদস্যদের মরদেহ না দেখিয়ে থানার পেছনের দরজা দিয়ে লাশ ময়নাতদন্তে পাঠানোয় এলাকাবাসী আরো ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থানার শৌচাগারে এভাবেই ঝুলেছিল হাসানুর রহমান মিলনের মরদেহ। করা হয় সুরতহাল। ছবি : এনটিভি

বিক্ষুব্ধরা দেবীগঞ্জ থানার ফটকের সামনে পুলিশের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ করে এবং শহরের চৌরঙ্গী মোড়ে সড়ক অবরোধ করে রাখে। ক্ষুব্ধ লোকজন এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেছেন। এ ঘটনায় ওই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

জানা গেছে, হাসানুর রহমান মিলন ঢাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করেন। ঈদের ছুটি কাটাতে কয়েক দিন আগে গ্রামের বাড়িতে আসেন। বড় ভাইয়ের শ্যালিকা কুলসুম নামের একটি মেয়ের সঙ্গে মিলনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। এই সম্পর্ক নিয়ে গতকাল রোববার রাতে পারিবারিক কলহ সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে বড় ভাই হাসিবুল ইসলাম মৌখিকভাবে বিষয়টি পুলিশকে জানায়। দেবীগঞ্জ থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম রাত আড়াইটার দিকে মিলনকে থানায় নিয়ে যান। আজ সোমবার দুপুরে দেবীগঞ্জ উপজেলার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ মাহমুদ হাসান ও দেবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এরপর পুলিশ কাউকে না দেখিয়ে না জানিয়ে থানার পেছন দিয়ে লাশ লুকিয়ে ময়নাতদন্তের জন্য পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।

পরিবারের লোকজন জানান, পারিবারিক বিবাদের কারণে অভিভাবকেরা রোববার গভীর রাতে মিলনকে দেবীগঞ্জ থানার পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন। দেবীগঞ্জ থানার এসআই কালাম তাঁকে থানা হেফাজতে আটকে রাখেন। দেবীগঞ্জ থানার পুলিশ ফোন করলে আজ সকাল ১০টার দিকে মিলনের দুই বোন খাবার ও কাপড় নিয়ে থানায় যান। তাঁরা থানাহাজতে মিলনকে দেখতে পাননি। তাঁকে থানার শৌচাগারের দেয়ালে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পান। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ওই এলাকার শত শত বিক্ষুব্ধ মানুষ দেবীগঞ্জ থানা ঘেরাও করে পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করতে থাকেন।

মিলনের বাবা হবিবর রহমান, মা হাসিনা, মামা সাদেকুল ইসলাম, বোন বিথী ও বিউটি জানান, বড় ছেলে হাসিবুলের শ্যালিকা কুলসুমের সঙ্গে মিলনের সম্পর্ক ছিল। এটা মিলনের বড় ভাই মানতে পারছিলেন না। এ নিয়ে রোববার গভীর রাতে দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ চলছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে মিলনের বাবা থানায় ফোন করে গভীর রাতে পুলিশের হাতে মিলনকে তুলে দেন। সোমবার সকালে থানার শৌচাগারে কম্বল দিয়ে ফাঁস লাগানো অবস্থায় মিলনের মৃতদেহ দাঁড়ানো অবস্থায় পাওয়া যায়।

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থানায় আজ সোমবার ছেলে হাসানুর রহমান মিলনের মৃত্যুতে কাঁদতে একপর্যায়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন মা হাসিনা। ছবি : এনটিভি

সুস্থ ও ভালো অবস্থায় মিলনকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ তাঁকে মেরে ফেলে গলায় ফাঁস লাগিয়ে রাখে বলে অভিযোগ করেছেন পরিবারের লোকজন।

বড় বোন বিউটি জানান, সোমবার সকালে থানা থেকে মিলনের জন্য কাপড় ও খাবার নিয়ে আসার জন্য পরিবারকে ফোন করা হয়। ছোট বোন বিথীকে নিয়ে তিনি ও অন্যরা খাবার নিয়ে থানাহাজতে গেলে মিলনকে না পেয়ে পুলিশকে জানায়। এ সময় পুলিশ জানায়, হাজতের শৌচাগারে মিলন আত্মহত্যা করেছে।

মিলনের বাবা হবিবর রহমান জানান, কিছুদিন আগে করতোয়া নদীতে মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে এসআই কালামসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে মিলনের ঝগড়া-বিবাদ হয়েছিল। সেই রাগেই পুলিশ তাঁর ছেলেকে হত্যা করতে পারে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন।

দেবীগঞ্জ পৌরসভার কাউন্সিলর আকসাদুল ইসলাম জানান, পরিবারের লোকজন গভীর রাতে মিলনকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। পুলিশ তাঁকে থানা হেফাজতে রাখে। সকালে তিনি কিভাবে আত্মহত্যা করল?

পুলিশের এসব সাজানো নাটক উল্লেখ করে কাউন্সিলর বলেন, পুলিশই মিলনকে হত্যা করেছে।

মিলনের মামা সাদেকুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘পুলিশ আমাদেরকে না দেখিয়ে লাশ লুকিয়ে কেন পঞ্চগড় পাঠাল আমরা জানি না। সুরতহাল রিপোর্টের সময়ও আমাদের কাউকে রাখল না। আমাদের লাশও দেখাল না। এটা পুলিশের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কি। পুলিশই মিলনকে মেরে ফেলেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। থানার টয়লেটে কোনোভাবেই কম্বল দিয়ে মিলন আত্মহত্যা করতে পারে না।’

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থানায় হাসানুর রহমান মিলনকে হত্যার অভিযোগ এনে এলাকাবাসী আজ সোমবার থানা ঘেরাও করে। ছবি : এনটিভি

এদিকে থানা হেফাজতে মিলনের মৃত্যুর বিষয়ে পুলিশ নানা রকম বক্তব্য দিচ্ছে। পুলিশ বলছে, তাঁকে ৬০ গ্রাম গাঁজাসহ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। অথচ পরিবারের লোকজন বলেছেন, গভীর রাতে দুই ভাইয়ের ঝগড়া বিবাদ এড়াতে মিলনকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছিল।

দেবীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের জানা মতে, সে (মিলন) মাদক ব্যবসায়ী এবং মাদকসেবী। এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে মাদকের মামলা আছে। গতকাল রাত ১টা ৫৫ মিনিটে অভিযান চালিয়ে ৬০ গ্রাম গাঁজাসহ আটক করা হয়। রাত ২টা ৩৫ মিনিটে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলা হওয়ার পরে সে স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল।’

ওসি বলেন, ‘সকাল ১০টার দিকে থানার সেন্ট্রিদের ডিউটি চেঞ্জ হয়। আগের সেন্ট্রি পরের সেন্ট্রিকে আসামিদের বুঝিয়ে দেন। মিলনকেও বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’

আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আজকে জেলার আইনশৃঙ্খলা কমিটি বা কল্যাণ সভার মিটিং ছিল। আমি সকাল সোয়া ৯টার দিকে থানা থেকে রওনা করেছি পঞ্চগড়ের উদ্দেশে। মিটিংয়ে থাকা অবস্থায় দুপুর ১২টার দিকে আমি সংবাদটা পাইছি (মিলনের মৃত্যু)। আমি পুলিশ সুপার মহোদয়কে বিস্তারিত অবহিত করেছি। পুলিশ সুপার মহোদয় ডিসি স্যারকে অবহিত করেছেন। এই মুহূর্তে দেবীগঞ্জের দায়িত্বে আছেন বোদার ইউএনও মহোদয়। ডিসি মহোদয় বোদার ইউএনও মহোদয়কে দায়িত্ব দিয়েছেন। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বোদার ইউএনও মহোদয়ের উপস্থিতিতে সুরতহাল হলো। এরপর পোস্ট মর্টেমের জন্য পাঠানো হলো। পোস্ট মর্টেমে যা আসবে সেই অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পরিবার দাবি করেছে, মিলনকে হত্যা করা হয়েছে-এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘তারা এখন শোকসন্তপ্ত পরিবার। তারা এখন অনেক কিছুই বলতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো সে (মিলন) হাজতখানার কম্বল দিয়ে বাথরুমের ভ্যান্টিলেশনের সঙ্গে দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। এটাই দৃশ্যমান। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুরতহালে পুরো বিষয়টি দেখেছেন।’

পরিবারের অভিযোগ, প্রেমঘটিত কারণে বিবাদ এড়াতে তারা মিলনকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছিল-এ বিষয়ে ওসি বলেন, ‘এটা সঠিক নয়। এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। এ ধরনের তথ্য আমার কাছে নেই।’

বোদার ইউএনও সৈয়দ মাহমুদ হাসান বলেন, ‘মিলনের সুরতহাল করেছি। লাশ ময়নাতদন্ত করার জন্য পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে পাঠানো করা হয়েছে। পরবর্তীতে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’