সেনাসদস্য সাইফুলের রক্তমাখা টি-শার্ট আজও গাছে ঝুলছে

Looks like you've blocked notifications!
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বংকিরা গ্রামের রাস্তায় এখনো ঝুলছে নিহত সেনাসদস্য সাইফুল ইসলামের রক্তমাখা টি-শার্ট। ছবি : এনটিভি

ঝিনাইদহে ডাকাত দলের হাতে নিহত সেনাসদস্য মো. সাইফুল ইসলামের রক্তমাখা টি-শার্ট আজও গাছে ঝুলছে। পুত্রহারা বাবার কান্নায় এলাকার বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন গ্রামের মানুষ।

সাইফুল হত্যায় জড়িত ডাকাতদলের সদস্যদের গ্রেপ্তার করে শাস্তির দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে সদর উপজেলার সাধুহাটী ইউনিয়নের বংকিরা হাইস্কুলের সামনের রাস্তায় মানববন্ধন ও সমাবেশ করে তারা।

গত ১৮ আগস্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে মুখোশপরা ডাকাতদলের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন সেনাসদস্য সাইফুল ইসলাম। তিনি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল সেনানিবাসে মেডিকেল কোরে সৈনিক পদে কর্মরত ছিলেন।  ঝিনাইদহ সদর উপেজলার বংকিরা গ্রামের হাফিজ উদ্দিনের ছেলে তিনি। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলেন তিনি।

দরিদ্র বাবা হাফিজ উদ্দিন ও মা বুলবুলি খাতুনের দুটি সন্তান। সামান্য জমিজমা চাষ করে ছোট সংসার নিয়ে সুখি ছিলেন দাঁরা। বড় ছেলে সাইফুল ২০০৬ সালে সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে যোগ দেন। ছোট ছেলে মনিরুল ইসলামেরও চাকরি হয় নৌবাহিনীর সৈনিক পদে। দুই ছেলের চাকরির সুবাদে পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। বড় ছেলের স্ত্রী মাগুরার বাবনপুর গ্রামের শামছুল মোল্লার মেয়ে শাম্মী আক্তার। তিনি দেশ সেরা অ্যাথলেট। তাঁদের রয়েছে দুটি সন্তান। সাড়ে ছয় বছর বয়সের আবু হুরাইরা ও মাত্র দেড় বছর বয়সের আবু হামজা। অবুঝ শিশুরা জানে না তাদের বাবা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না তাদের কাছে।

হত্যার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী নৌবাহিনীর সৈনিক মনিরুল ইসলাম। তিনি ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ১৮ আগস্ট রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে একটি মোটরসাইকেলে চড়ে পাশের দশমাইল বাজার থেকে নিজ বাড়ি ফিরছিলেন তারা। সঙ্গে ছিলেন নিহত সাইফুলের শ্বশুর শামছুল মোল্লা। পথে স্থানীয় বংকিরা পুলিশ ক্যাম্প থেকে কয়েকশ গজ আসা মাত্র ডাকাতদলের কবলে পড়েন তাঁরা।

মানববন্ধনের সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন সেনাসদস্য সাইফুল ইসলামের বাবা হাফিজ উদ্দিন। ছবি : এনটিভি

মনিরুল ইসলাম বলেন, একদল ডাকাত পুলিশ ক্যাম্পের উত্তর দিকের রাস্তায় গাছ ফেলে ব্যরিকেড দেয়। ওই রাস্তা দিয়ে আসছিলেন তাঁরা। কাছে আসা মাত্রই ওত পেতে থাকা ডাকাতরা তাদের চিনে ফেলে। হঠাৎই ডাকাতরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে সাইফুলের হাতে ও ঘাড়ের পেছনে আঘাত করে। এ সময় নিজের টি-শার্ট খুলে ভাইয়ের রক্তমাখা শরীর ঝাপটে ধরেন তিনি। ডাকাতরা তাঁর ওপরও চড়াও হয়।

নিহতের শ্বশুর ভয়ে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নেন। দৌঁড়ে গ্রামের পুলিশ ক্যাম্পের কাছে গিয়ে চিৎকার করতে থাকেন মনিরুল। তিনি অভিযোগ করেন, সে সময় পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবদুল  মালেক একটি চায়ের দোকানে বসে চা পান করছিলেন। ঘটনাস্থল থেকে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার দেওয়া পরও তিনি নড়াচড়া করেননি। পরে এলাকার লোকজন ঘটনাস্থলের দিকে ছুটে যায়। তার আগেই মারা যান ভাই সাইফুল ইসলাম।

মনিরুল আরো বলেন, ডাকাতরা গরুর ব্যাপারীদের টার্গেট করেছিল। কিন্তু ব্যাপারীরা ছিল তাদের পেছনে।

ঘটনার পর সাইফুলের বাবা থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন।

আজ বৃহস্পতিবার সাইফুলদের গ্রামের বাড়ি গেলে দেখা যায়, রক্তমাখা টি-শার্টটি ঘটনাস্থলের একটি গাছে ঝুলছে। তাতে লেগে আছে রক্তের দাগ।

মানববন্ধনে উপস্থিত গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। সাইফুলের মা বুলবুলি খাতুন বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। ফুপু মনোয়ারা বেগমের আর্তচিৎকারে এলাকার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের চোখে পানি। তাদের দাবি, আর কোনো বাবাকে যেন সন্তানের লাশ কাধে নিতে না হয় !

সাধুহাটী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান কাজী নাজির উদ্দিন বলেন, ঘটনার পর থেকে গ্রামের মানুষের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। ডাকাতদলের সদস্যদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন তিনি।

সেনাসদস্য সাইফুল ইসলাম হত্যার বিচারের দাবিতে আজ বৃহস্পতিবার ঝিনাইদহ সদর উপজেলার বংকিরা গ্রামের রাস্তায় মানববন্ধন করা হয়। ছবি : এনটিভি

বংকিরা গ্রামের একাধিক ব্যক্তি বলেন, তাঁদের মধ্যে এখনো ডাকাত আতঙ্ক বিরাজ করছে। এলাকায় এর আগে অসংখ্য ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার দিন পুলিশ ক্যাম্পের এএসআইয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।

এএসআই আবদুল মালেক অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ঘটনা কয়েক দিন আগে তিনি বংকিরা ক্যাম্পে যোগ দেন। ঘটনার সময় ক্যাম্পের পাশের বাজারের একটি দোকানে চা পান করার সময় নিহতের ছোট ভাইয়ের চিৎকার শুনতে পান তিনি। এরপর ঘটনাস্থলের দিকে ছুটে যান এবং মুমূর্ষু সাইফুলকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের পাঠান বলে দাবি করেন তিনি।

এ বিষয়ে বংকিরা পুলিশ ক্যাম্পের দায়িত্বরত উপপরিদর্শক (এসআই) শফিউল ইসলাম বলেন, ঘটনার রাতেই তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এঁরা হলেন বংকিরা গ্রামের আকিমুল, বোড়াই গ্রামের মিজানুর রহমান মিজান ও চুয়াডাঙ্গার ভুলটিয়া গ্রামের ডালিম। আকিমুল ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবাবনবন্দি দিয়েছেন।

সাইফুল হত্যার ঘটনায় ডাকাতদলের নয়জন জড়িত ছিল এমন তথ্য দিয়ে এসআই শফিউল বলেন, বাকিদের গ্রেপ্তার করার জন্য অভিযান চলছে।

মানববন্ধন ও সমাবেশ

আজ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত মানববন্ধন ও সমাবেশে বক্তারা এলাকার ডাকাতদলের সদস্যদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। এ সময় বক্তব্য দেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কাজী নাজিম উদ্দীন, ইউপি সদস্য আমিরুল ইসলাম, সুকদেব কর্মকার, স্কুলশিক্ষক আবদুর রশিদসহ অনেকে।