২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায় কাল

সর্বোচ্চ শাস্তি চায় রাষ্ট্রপক্ষ, ন্যায়বিচার চায় আসামিপক্ষ

Looks like you've blocked notifications!

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় আগামীকাল বুধবার ঘোষণা করা হবে। পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন এ রায় ঘোষণা করবেন।

১৮ সেপ্টেম্বর শেষ হয় বিচার প্রক্রিয়া  

গত ১৮ সেপ্টেম্বর উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে ১০ অক্টোবর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ১-এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিন। ১১৯তম কার্যদিবসে মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হয়। এর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ ৩০ ও আসামিপক্ষ ৮৯ কার্যদিবস ব্যয় করেছে। ঘটনার ১৪ বছর এক মাস ২০ দিন পর চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করা হচ্ছে।

রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি  প্রত্যাশা করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ’জাতি দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে এ মামলার  রায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। এ ঘটনা কারাবালা হত্যাকণ্ডের মতো দুঃখ জনক কাহিনী। এ ঘটনায় ২৪ জন মানুষকে হত্যা করা হয়। শেখ হাসিনাসহ শতাধিক মানুষ আহত হয়। অনেকে চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ববরণ করে।’ তিনি আশা করেন আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে।

অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, ’ঘটনা দুঃখজনক। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে এ মামলায় অনেককে জড়ানো হয়েছে। এ কারণে আমরা ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করি।’

মামলায় মোট আসামি ৫২ জন  

এ মামলায় মোট ৫২ জন আসামির মধ্যে তিনজনের অপর মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে যায়।  আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯ জনে। এর মধ্যে তারেক রহমানসহ ১৮ জন পলাতক। বাকি আসামিদের মধ্যে কারাগারে ছিলেন ২৩ জন এবং জামিনে ছিলেন আটজন। ওই আট জনেরও জামিন বাতিল করেন আদালত।

অপর মামলায় ফাঁসি তিনজনের

২১ আগস্টের ঘটনায় পৃথক মামলায় মোট আসামি ৫২ জন। এর মধ্যে তিন আসামির অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় তাঁদের মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, মুফতি আবদুল হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল।

মোট কারাগারে রয়েছেন ৩১ জন  

এ ঘটনায় করা দুটি মামলার ৫২ আসামির মধ্যে জামিনে ছিলেন আট জন। পরে গত ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁদের জামিন বাতিল করে কারাগারে প্রেরণ করা হয়। তাঁরা হচ্ছেন,বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভাগ্নে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব.) সাইফুল ইসলাম ডিউক, ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার আরিফুল ইসলাম আরিফ, পুলিশের সাবেক তিন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (অব.) রুহুল আমিন, এএসপি (অব.) আবদুর রশিদ ও এএসপি (অব.) মুন্সি আতিকুর রহমান।  

আগে থেকে কারাগারে ছিলেন, বিএনপি নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, ডিজিএফআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) তখনকার মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিম।

কারাগারে থাকা অন্য আসামিরা সবাই জঙ্গি সংগঠন হুজির সদস্য বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। তাঁরা হলেন,  শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল,মাওলানা শেখ আবদুস সালাম, মো.আবদুল মাজেদ ভাট ওরফে ইউসুফ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোহাম্মদ ওরফে জিএম, মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আবু ওমর আবু হোমায়রা ওরফে পীর সাহেব,মাওলানা সাব্বির আহমেদ ওরফে আবদুল হান্নান সাব্বির, মাওলানা শওকত ওসমান ওরফে শেখ ফরিদ, মহিব্বুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডাক্তার জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো. জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মাইন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মাইন ওরফে খাজা ওরফে আবু জানদাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন ওরফে আবদুর রাজ্জাক, রফিকুল ইসলাম ওরফে সবুজ ওরফে খালিদ সাইফুল্লাহ ওরফে শামিম ওরফে রাশেদ, মো. উজ্জ্বল ওরফে রতন, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া এবং আবু বকর সিদ্দিক ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার।

পলাতক ১৮ জন

পলাতক ১৮ আসামি হলেন- তারেক রহমান (লন্ডনে), শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন কায়কোবাদ (সৌদি আরবে), হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক হানিফ (কলকাতায়), ব্রিগেডিয়রি জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন (আমেরিকায়), লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার (কানাডায়), বাবু ওরফে রাতুল বাবু ভারতে, আনিসুল মোর্সালীন এবং তার ভাই মুহিবুল মুক্তাকীন ভারতের কারাগারে এবং মাওলানা তাজুল ইসলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়েছেন। অভিযুক্ত পলাতক হারিস চৌধুরীর অবস্থান জানা যায়নি। জঙ্গি নেতা শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবু বকর, ইকবাল, খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর, মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার (পূর্ব) এবং উপকমিশনার (দক্ষিণ) ওবায়দুর রহমান ও খান সাঈদ হাসান বিদেশে অবস্থান করছে।  

নিহত হয়েছিলেন ২৪ জন

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। হামলায় আওয়ামী মহিলা লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী মারা যান।

এ ছাড়া আহত হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রয়াত সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফ, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, সাহারা খাতুন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন, মাহবুবা পারভীন, নাসিমা ফেরদৌস, রুমা ইসলামসহ শতাধিক নেতাকর্মী।

ঘটনার পর মামলা

গ্রেনেড হামলার ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। এ মামলাটির প্রথমে তদন্ত শুরু করে থানা পুলিশ। পরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ হয়ে তদন্তের দায়িত্ব পরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে। অবশ্য এর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিল ও সাবের হোসেন চৌধুরী আরো দুটি মামলা করেছিলেন। পরে এসব মামলা বিশেষ ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়।

২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন  

২০০৪ সালের ২২ আগস্ট বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করে সরকার। মাত্র এক মাস ১০ দিনের মাথায় ওই বছরের ২ অক্টোবর কমিশন সরকারের কাছে ১৬২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, কমিশনের সংগৃহীত তথ্য-প্রমাণ সন্দেহাতীতভাবে ইঙ্গিত করে,২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তিশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছিল ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে। এসব লোক প্রধানত একটি সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়, যাদের সমাবেশে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার মতো ভালো জ্ঞান ছিল। যদিও ওই প্রতিবেদনে বিদেশি শক্তি বলতে কোনো দেশের নাম বলা হয়নি।

আলোচিত জজ মিয়া

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার তদন্তের এক আলোচিত অধ্যায় জজ মিয়া। ২০০৫ সালের ৯ জুন গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীর সেনবাগের একটি চায়ের দোকান থেকে তাকে আটক করে নিয়ে যাওয়া হয় সেনবাগ থানায়। ঢাকা থেকে সিআইডির অনুরোধ পেয়ে সেনবাগ থানা পুলিশ জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের জন্য সোর্স নিয়োগ করে। পরে ৯ জুন বেলা ১টার দিকে জজ মিয়াকে আটক করে থানায় খবর দেয়। এরপর পুলিশ তাকে সেখান থেকে থানায় নিয়ে আসে। ১৫ দিন সিআইডি পুলিশের হেফাজতে থাকার পর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর গ্রেনেড হামলার মামলায় তিনি 'স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি'দিয়েছেন বলে জানায় পুলিশ। পরে এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয় যখন গণমাধ্যমে ফাঁস হয় যে জজ মিয়ার বিষয়টি পুলিশের সাজানো। আসামি করার বদৌলতে তার পরিবারকে টাকা দেওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় উঠে আসে। এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহের পর ২০০৮ সালে জজ মিয়াকে আসামির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে অভিযোগপত্র জমা দেয় সিআইডি। পরে আদালত এ মামলা থেকে তাঁকে অব্যাহতি দেন। ২০০৯ সালে মুক্তি পান জজ মিয়া।

২০১১ সালে সম্পূরক চার্জশিটে তারেক-বাবর

গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করে সিআইডি। সেদিন বিশেষ নিরাপত্তার মধ্যে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা-সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহহার আকন্দ স্বাক্ষরিত অভিযোগপত্রটি দাখিল করেন এস আই গোলাম মাওলা। দুটি পৃথক ট্রাঙ্কে ভর্তি করে আনা অভিযোগপত্রে নতুন করে ৩০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর আগের অভিযোগপত্রে ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। নতুনভাবে অভিযুক্তদের মধ্যে স্থান পান বিএনপিনেতা তারেক রহমান,সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদসহ অনেকে।

সাত বছরে ৬ তদন্ত কর্মকর্তা

গ্রেনেড হামলার পর মামলা হয়েছিল পৃথক তিনটি। এর মধ্যে প্রথম সাত বছরের মধ্যেই তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তন হয় মোট ছয়বার। প্রথম তদন্ত হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে কিন্তু কোনো প্রতিবেদন দাখিল হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে নতুন তদন্তে সিআইডির এএসপি ফজলুল কবীর ২০০৮ সালের ১১ জুন অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই অভিযোগ পত্রে মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে অভিযুক্ত করা হলেও গ্রেনেডের উৎস ও মদদদাতাদের শনাক্ত করা হয়নি। বর্তমান সরকার আমলে রাষ্ট্র পক্ষের আবেদনের পর আদালত মামলার বর্ধিত তদন্তের আদেশ দেন। ১৩ দফা সময় বাড়িয়ে ২০১১ সালের ৩ জুলাই সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার মধ্য দিয়ে ভয়ঙ্কর গ্রেনেড হামলার তদন্ত শেষ হয়।

২০১২ সালের ২৮ মার্চ : মামলার বিচার শুরু

২০১২ সালের ২৮ মার্চ বুধবার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় তারেক রহমানসহ ৫২ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচার কাজ শুরু হয় । ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচারক মামলা কার্যক্রম শুরু করেন৷

স্বীকারোক্তি মূলক বক্তব্য  

গ্রেনেড হামলার দায় স্বীকার করে ঢাকার সিএমএম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন আটজন আসামি। তাঁরা হলেন হুজি নেতা মুফতি হান্নান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা. জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, জাহাঙ্গীর আলম, আরিফ হাসান সুমন ও রফিকুল ইসলাম সবুজ।