বাগেরহাটে বিষমুক্ত কৃষিতে মতিনের সাফল্য

Looks like you've blocked notifications!
বাগেরহাটের মোংলায় কৃষিবিজ্ঞানী সৈয়দ আবদুল মতিনের জৈব কৃষি খামারের সামনের দৃশ্য। ছবি : এনটিভি

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার খুলনা-মোংলা মহাসড়কের পাশে ভরসাপুর বাসস্ট্যান্ডের পূর্বদিকে দুই একর জমির ওপর একটি ফলমূল ও শাকসবজির খামার। ‘ফিউচার অর্গানিক ফার্ম’ নামে এই খামারের উদ্যোক্তা কৃষিবিজ্ঞানী সৈয়দ আবদুল মতিন। খামারের একপাশে সারি সারি আমগাছ। তার পাশেই রয়েছে পেঁপেগাছের সারি। এ ছাড়া রয়েছে মৌসুমি শাকসবজির ক্ষেত আর বিভিন্ন ফলের গাছ।

খামারে রয়েছে দুটি পুকুর। একটিতে দেশি প্রজাতির খড়ুল (খড়সোলা), আরেকটিতে দেশি প্রজাতির শৈল, টাকিসহ অন্যান্য মাছ। পুকুরের পাশে ছোট ছোট কয়েকটি হাঁস-মুরগির ঘর দেখা গেল।

খামারের নিয়মিত শ্রমিক সোয়াইব জানালেন, তিনি পাঁচ বছর ধরে এই খামারে কাজ করেন। জৈব বালাইনাশক ও মেহগনি ফলের তেল দিয়ে শাকসবজির চাষ করা হয়। অনেক দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এসে এখান থেকে শাকসবজি ও ফলফলাদি কিনে নিয়ে যান। এখানে বাজারের কোনো ধরনের কীটনাশক ব্যবহার করা হয় না।

সম্প্রতি খামারটি পরিদর্শনে যান এই প্রতিবেদক। এ সময় খামারে আসেন মোংলা শিল্প এলাকার দুবাই-বাংলাদেশ সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক মো. শামীম হোসাইন। তিনি খামার ঘুরে বিভিন্ন প্রকারের ফল ও শাকসবজি সংগ্রহ করেন। আলাপচারিতায় জানান, নিয়মিতই এই খামারে উৎপাদিত শাকসবজি ও ফলফলাদি কেনেন শামীম।

খামারের উদ্যোক্তা মতিন বলেন, ‘সমাজের প্রতি নিজের দায়বোধ থেকে ২০১২ সালে দুই একর জমি নিয়ে এই খামার শুরু করি। শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদনে কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। এতে খাদ্যে বিষের পরিমাণ অনেকগুণ বেড়েছে, যা আমাদের শরীরকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জমিতে পাঁচ ভাগ জৈব সার থাকার কথা থাকলেও এখন তার এক ভাগও নেই।’

সৈয়দ আবদুল মতিন জানান, প্রতিনিয়ত রাসায়নিক সারের ব্যবহারের ফলে মাটির অণুজীব ধ্বংস হয়ে গেছে। যে কারণে মাটির প্রাকৃতিক গুণাগুণ একেবারেই নষ্ট হয়েছে। আগে কেঁচো মাটিতে প্রাকৃতিকভাবে সার তৈরি করা হতো। এখন সেটা আর সম্ভব হচ্ছে না। তার পরিবর্তে কেঁচোকে ব্যবহার করে ভার্মিকম্পোস্ট (কেঁচো সার) তৈরি করা হচ্ছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটি, পানি ও বায়ুদূষণ বাড়ছে। এর থেকে মুক্তির জন্য কেমিক্যালবিহীন অর্গানিক সার ও ভেষজ কীটনাশক ব্যবহার শুরু করা হয়েছে। এতে শতকরা ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ সাফল্য পাওয়া গেছে।

সৈয়দ আবদুল মতিন নিজের খামারে উৎপাদিত মেহগনি তেল, মেহগনি খৈল ও কেঁচো সার ব্যবহার করেন। কীটনাশকের পরিবর্তে মেহগনি তেল দিয়ে তিনি শাকসবজি ও ফলমূলের পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করছেন। এতে সাফল্যও মিলেছে বেশ। মেহগনি ফলের নির্যাস দিয়ে কীটনাশক তেল উৎপাদন ছাড়াও তিনি মেহগনি হারবাল সাবান, মেহগনি চা ও ফফ উকুননাশক তেল, মসকিটো  রি-প্ল্যান্ট ও জৈব খৈল উৎপাদন করছেন।

আবদুল মতিন বলছিলেন, একটি কৃষি খামার করলেই হবে না। সেটি ইকোসিস্টেমে তৈরি করতে হবে। তিনি সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই গবেষণা শুরু করেন। অর্থকষ্টের ভেতর দিয়েও এই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে বিষমুক্ত কৃষিখাদ্য উৎপাদনে একটি অর্গানিক ফুড পার্ক স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।

বাগানসংলগ্ন ভরসাপুর আইপিএম ক্লাবের সভাপতি শেখ আনসার আলী বলেন, ‘মতিন স্যার বিষমুক্ত খামার স্থাপন করায় এ এলাকার চাষিদের অনেকে উৎসাহিত হয়েছেন। ভেষজ কীটনাশক ও জৈব সার দিয়ে খামারিরা খামার করায় ফসলের উৎপাদনও বেড়েছে।

এ বিষয়ে রামপাল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোতাহার হোসেন বলেন, কৃষিবিজ্ঞানী সৈয়দ আবদুল মতিনের অর্গানিক কৃষি খামারের মতো আরো খামার স্থাপন করা হলে বিষমুক্ত কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ একটি রোলমডেল হতে পারে। এ জন্য তিনি সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তুষার কুমার পাল বলেন, সৈয়দ আবদুল মতিনের এমন উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। এ ধরনের অর্গানিক ফার্ম দেশব্যাপী স্থাপন করা গেলে কৃষিতে অভাবনীয় বিপ্লব ঘটানো সম্ভব।