‘পোড় খাওয়া মানুষের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নিবিড়’
পবা ও মোহনপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত জাতীয় সংসদের রাজশাহী-৩ আসন। রাজশাহী মহানগরীকে ঘিরে থাকা এ আসন থেকে দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশায় মাঠে সক্রিয় রয়েছেন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহা. আসাদুজ্জামান আসাদ। দলকে সংগঠিত ও গতিশীল করতে দীর্ঘদিন ধরে গ্রাম থেকে গ্রামে জনসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে তাঁর সঙ্গে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের।
এনটিভি অনলাইন : রাজনীতিতে জড়ালেন কীভাবে?
মোহা. আসাদুজ্জামান আসাদ : ছাত্ররাজনীতি দিয়ে আমার শুরু। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ছিলেন বাবা। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের পর যখন আওয়ামী লীগের দুঃসময়, তখন আমাদের বাড়িতে অনেক রাত পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মিটিং হতো। দলের নেতারা গোপনে মিটিং করতেন। সেসব মিটিংয়ে বাবার পাশে আমি বসতাম। সেখান থেকেই বঙ্গবন্ধুকে চেনা শুরু আমার। তারপর প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে যখন হাইস্কুলে উঠি, তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছি। এসএসসি পরীক্ষার আগেই আমি নগরীর ৬ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছি। রাজশাহী সিটি কলেজে পড়াকালে কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম। এরপর রাজশাহী মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সভাপতি নির্বাচিত হই। ছাত্রলীগের পর যুবলীগ, এভাবে পর্যায়ক্রমে মূল দলে আসি।
এনটিভি অনলাইন : একাদশ জাতীয় সংসদে রাজশাহী-৩ আসনে আপনি দলের মনোনয়নপ্রত্যাশী। কেন নির্বাচন করতে চান?
মোহা. আসাদুজ্জামান আসাদ : যেহেতু ছাত্ররাজনীতি থেকে আমার রাজনৈতিক জীবন শুরু, সংগত কারণে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সর্বোপরি চেষ্টা থাকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া। আমিও তৃণমূলের একজন কর্মী হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে চাই।
এখন বলতে পারেন, পবা-মোহনপুর কেন? এখানে আমি নির্বাচন করতে চাই, কারণ একসময় শহর আর পবা একই আসন ছিল। পবাতে আমার জন্ম, পবাতেই বেড়ে ওঠা। সে কারণেই আমি পবা-মোহনপুর আসনটি বেছে নিয়েছি। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সংগঠনকে গতিশীল করার জন্য এই আসনটিকে আবারও নৌকার পক্ষে রাখা প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে নেত্রী শেখ হাসিনা যদি আমাকে নৌকা দেন, তাহলে আমি শতভাগ বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত। আর নেত্রী যদি অন্য কাউকেও দেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তাঁকে জয়ী করতে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে।
এনটিভি অনলাইন : রাজশাহী-৩ আসনে কী কী উন্নয়ন করা যেত, যা অতীতে কোনো সংসদ সদস্য করেননি?
মোহা. আসাদুজ্জামান আসাদ : রাজশাহীতে একটি বিমানবন্দর আছে, সেটি রাজশাহী-৩ আসনের মধ্যে পড়ে। আর আমাদের এখানে প্রচুর পরিমাণে পান, মাছ ও সবজি উৎপাদিত হয়। অর্থকরী এসব ফসল দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বিদেশেও যায়। রাজশাহীতে যদি একটি কার্গো বিমানবন্দর চালু করা যায়, তাহলে আমাদের এই পণ্যগুলোর উৎপাদক কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাবেন এবং এসব পণ্য সরাসরি বহির্বিশ্বে যাওয়ার রাস্তা তৈরি হবে।
এনটিভি অনলাইন : এলাকার সমস্যা এবং সম্ভাবনা নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
মোহা. আসাদুজ্জামান আসাদ : পবা-মোহনপুরের সবচেয়ে বড় সমস্যা মাদক। যেহেতু পবা সীমান্তবর্তী একটি এলাকা, এখানে মাদকের একটি বিশাল সিন্ডিকেট কাজ করে। এখন পর্যন্ত এই সিন্ডিকেট মাথা নত করেনি। এই মাদক নির্মূলের বিষয়টি হবে আমার মূল পরিকল্পনার একটি। এখানে কিছু প্রাগৈতিহাসিক সম্পদ আছে। এগুলো যদি সংস্কার করা যায়, তাহলে এই এলাকা পর্যটন এলাকা হিসেবেও ঘোষিত হতে পারে। আমার সেই চেষ্টা থাকবে। দারুশা অঞ্চলে একসময় দাঙ্গা হয়েছিল, অনেক মানুষকে সে সময় হত্যা করা হয়েছিল, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ করতে চাই। পবা উপজেলায় রাস্তার পাশে বেশকিছু খাল আছে, এসব খালের দুপাশে সরকারি জমি আছে। এগুলো পুনরুদ্ধার করে যদি বিনোদন কেন্দ্র করা যায়, তাহলে একদিকে মানুষের আয় বাড়বে, অন্যদিকে মানুষ নির্মল প্রশান্তির জায়গা খুঁজে পাবে।
পবা-মোহনপুর উপজেলা ধীরে ধীরে বাণ্যিজ্যিক এলাকায় পরিণত হচ্ছে, এখানে অনেকগুলো কলকারখানা তৈরি হচ্ছে, বিশেষ করে পাটকল, আলুর হিমাগার। এসব জায়গায় আরো কীভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটানো যায়, সেসবের একটি সমন্বিত পরিকল্পনা করা হবে। আমি মনে করি, এই পরিকল্পনা গ্রহণ করার ক্ষমতা, দক্ষতা আল্লাহ আমাকে দিয়েছে। আমি যদি এই আসনের সংসদ সদস্য হই এবং শেখ হাসিনা যদি আবারও প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে এসব প্রকল্প আমি তার কাছ থেকে আদায় করে নিতে সক্ষম হবো।
এনটিভি অনলাইন : তৃণমূল আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
মোহা. আসাদুজ্জামান আসাদ : আমি এটা গর্ব করে বলতে পারি, শুধু পবা মোহনপুর উপজেলা না, আমি রাজশাহী জেলার ত্যাগী নেতাকর্মীদের প্রত্যেকের বাড়ি চিনি, গ্রাম চিনি। আমি যেহেতু ছাত্ররাজনীতি থেকে মহানগর ও জেলায়, সব জায়গায় নেতৃত্ব দিয়েছি এবং দিচ্ছি, আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সব সংগঠনের গোটা জেলার তৃণমূলের পোড় খাওয়া মানুষদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ অত্যন্ত নিবিড়। রাজশাহী জেলার যেকোনো কর্মী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে এলে কিংবা মামলা-সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে কোনো কর্মী আদালতে এলে, আমি তাদের সার্বিক সহযোগিতা করি। সব মিলিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে আমি অতীতে ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও থাকব।
এনটিভি অনলাইন : স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ জেলার সংসদ সদস্যদের বিপক্ষে কেন?
মোহা. আসাদুজ্জামান আসাদ : যাঁরা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হন, তাঁদের মনে রাখতে হবে দলীয় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাঁদের দলের অধীনে চলতে হবে। সংসদ সদস্য যদি দল পরিচালনা করার চেষ্টা করে বা দলের লোকজনকে কর্মচারী মনে করে, তখনই এর ব্যত্যয় ঘটে। প্রতি তিন মাস পর পর সংসদ সদস্যদের সঙ্গে উপজেলা কমিটির সভা হওয়ার কথা, সেই সভাগুলো হয় না। কর্মী বিমুখতার কারণেই সংসদ সদস্যরা দলের সঙ্গে বসেন না। সে ক্ষেত্রে দলের সঙ্গে এমপিদের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তবে আমরা সেই দূরত্ব ঘোচাতে চেষ্টা করছি, অনেকটা কাছাকাছি নিয়ে এসেছি।
এনটিভি অনলাইন : সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের উসকে দেওয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে আপনার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?
মোহা. আসাদুজ্জামান আসাদ : একটা উদাহরণ দিই। গত ১ মে মোহনপুরে শ্রমিক লীগের একটি বড় সমাবেশ ছিল। সেই সমাবেশে আমি গিয়েছিলাম। সমাবেশ আয়োজনের সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগের নয়জন নেতাকর্মীকে বিএনপির একটি সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মামলায় আসামি করে মামলা দেওয়া হলো। ওই রাতেই তাদের গ্রেপ্তার করা হলো। ঈদুল আজহা তাদের জেলখানাতেই করতে হলো। অভিযোগ আছে, স্থানীয় সংসদ সদস্যের ইঙ্গিতে এই মামলা করা হয়েছে। এ ধরনের মামলা গোটা জেলার বিভিন্ন জায়গায় আরো আছে। এসব মামলার আসামিদের পক্ষে আমার অবস্থান। সংগত কারণে যাদের ইন্ধনে এসব মামলা হচ্ছে, তারা আমার বিপক্ষে দাঁড়াবেন, এটা তো স্বাভাবিক। এ ধরনের মামলা ছাড়াও আমাদের সংগঠনের অনেক নেতাকর্মী আছে, যাদের জমিজমার সমস্যা থাকে, তাদের এসব সমস্যা আমি দেখভাল করি।
এনটিভি অনলাইন : রাজশাহী-৩ আসনের এমপি আয়েন উদ্দিন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
মোহা. আসাদুজ্জামান আসাদ : এমপি আয়েন আমার ছোট ভাইয়ের মতো। তবে তার কর্মকাণ্ডের পরিধি আরো বাড়ানো উচিত ছিল। দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তার আরো বেশি করে সমন্বয় করার দরকার ছিল। যে কারণে তার আগের সংসদ সদস্যকে মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে, সেসব কারণ থেকে শিক্ষা নিয়ে সে যদি কাজ করত, তাহলে সংগঠন লাভবান হতো, মূল্যায়িত হতো। আমি মনে করি, এই কাজগুলো সে করেনি।
এনটিভি অনলাইন : রাজশাহী-৩ আসনে জামায়াত-বিএনপির শক্ত অবস্থান আছে। এ নিয়ে আপনার চিন্তা কী?
মোহা. আসাদুজ্জামান আসাদ : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর যেভাবেই হোক এ অঞ্চলে জামায়াতের একটি আধিপত্য ছিল। এত অল্প সময়ের মধ্যে তা নষ্ট হবে, সেটা বিবেচনা করা ঠিক হবে না। জামায়াতের যে পরিমাণ ভোট ছিল, সে পরিমাণ ভোট আর নেই, তবে এখনো কিছু ভোট তাদের আছে। আর বিএনপিরও একটি বড় অংশ আছে এখানে। তবে এখানে জামায়াত-বিএনপির ঐক্যতে আওয়ামী লীগের ভোট প্রায় সমান সমান হয়ে যায়। জামায়াতের প্রতি মানুষের আগে যে ধারণা ছিল, সেই ধারণা থেকে মানুষ বেরিয়ে এসেছে। জামায়াত রাজনৈতিকভাবে আর আগের অবস্থানে নেই। আর বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা একেবারেই দুর্বল। সব মিলিয়ে জামায়াত-বিএনপি অন্য কারো সঙ্গে ঐক্য করেও এ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করতে পারবে না, যদি আওয়ামী লীগের ঐক্য অটল থাকে।
এনটিভি অনলাইন : রাজশাহী-৩ আসনে আওয়ামী লীগের অনেকেই মনোনয়ন চান। সে ক্ষেত্রে আপনার অবস্থান কী?
মোহা. আসাদুজ্জামান আসাদ : আওয়ামী লীগে অনেকই আছেন, যাঁরা সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ। তাঁরা যে যার মতো নৌকার পক্ষে কাজ করবেন। তবে আমাদের মধ্যে সমন্বয় রয়েছে। নেত্রী যাকে নৌকা দেবেন, তাঁর পক্ষেই আমরা সকলে একাট্টা হয়ে কাজ করব। আর আমি আমার নিজের বিষয়ে বলতে চাই, ভোটের হিসাবে মোহনপুরে নৌকা প্রথম হয়। পবায় এসে আমাদের ব্যাপক একটি ব্যবধান হয়ে যায়। পবা উপজেলার হড়গ্রাম, হরিপুর, দামকুড়া, দর্শনপাড়া ও হুজরিপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দুর্বল অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। আমি যদি প্রার্থী হই, তাহলে এ অঞ্চলে ব্যবধানটা থাকবে না। কারণ, আমার প্রতি এসব অঞ্চলের মানুষের একটা বিশ্বাস আছে। এটি রাজনৈতিক বিবেচনায় না, ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তাদের প্রতি আমার যে শ্রদ্ধা এবং আমার প্রতি তাদের যে মমত্ববোধ, তা থেকে আমি মনে করি এই অঞ্চলের ভোট আমি বেশি পাব।