ইসির সঙ্গে ঐক্যফ্রন্টের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়-হট্টগোল

Looks like you've blocked notifications!
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একটি প্রতিনিধিদল সোমবার বিকেলে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসে। ছবি : এনটিভি

সুষ্ঠু নির্বাচন, সেনা মোতায়েন, ইভিএম বাতিল, সংলাপের ফলাফল দেখে তফসিল ঘোষণাসহ আরো কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একটি প্রতিনিধিদল আজ সোমবার বিকেলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে বৈঠকে বসে। বৈঠকে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় ও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করার মতো ঘটনা ঘটেছে বলে ইসি ও ঐক্যফ্রন্ট সূত্রে জানা গেছে।

জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একটি প্রতিনিধি আজ বিকেল পৌনে ৪টার দিকে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে গিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে বসে। প্রতিনিধিদলে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সদস্য সুলতান মোহাম্মদ মুনসুর আহমেদ ও গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ।

অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বৈঠকে নেতৃত্ব দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। এ সময় অপর চার কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও শাহাদত হোসেন চৌধুরী এবং কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন।

নির্বাচন কমিশন ও ঐক্যফ্রন্ট সূত্রে জানা গেছে, বৈঠকে ঐক্যফ্রন্টের নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহামুদুর রহমান মান্নার সঙ্গে সিইসির উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। এ ছাড়া প্রতিনিধিদলের আরেক সদস্য পুরো কমিশনের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার না করতে অনুরোধ জানিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটা বাতিল করতে বলা হয়। ইভিএমের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বৈঠকে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমি নিশ্চিত হয়ে বলছি ইভিএম নামক এই যন্ত্রে ম্যানিপুলেট করা সম্ভব। যেটা কেউ চাচ্ছে না। আপনারা নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হয়ে কেন চাচ্ছেন? তবে আমরা কিন্তু নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানাতে আসিনি। যদিও জনগণের নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা নেই।

মান্নার বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে সিইসি কে এম নুরুল হুদা বলে ওঠেন, আপনারা তো বড় বড় কথা বলেন।

সিইসির কথা শেষ হওয়ার আগেই মান্না বলে উঠেন, ‘মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ!

ইসি সূত্র জানায়, ওই সময় পুরো পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অন্য কমিশনাররাও সেই সময় মান্নার কথার জবাব দিতে যান। তখন ঐক্যফ্রন্টের একজন নেতা সিইসির প্রতি বলে ওঠেন, হুদা ভাই, প্লিজ আপনারা শান্ত হোন। এরপর পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আবারও আলোচনা চলতে থাকে।

এরপর মাহমুদুর রহমান মান্নার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, কমিশনের ওপর যদি মানুষের আস্থা না থাকে আপনাদের রাজনৈতিক দলের ওপরও কিন্তু মানুষের আস্থা নেই। আপনারা শুধু শুধু ইভিএমের ব্যবহারবিধি না জেনে এসব কথা বলছেন। প্রয়োজনে আপনারা টেকনিক্যাল টিম নিয়ে এসে যাচাই করেন। আমি আপনাদেরকে চ্যালেঞ্জ করছি ইভিএমে কারচুপি করার সুযোগ নেই। রাজনৈতিকভাবে না দেখে যদি আপনারা ভেবে দেখার চেষ্টা করতেন তবে আওয়ামী লীগ নয়, আপনারাই আগে এটা ব্যবহার করতে উৎসাহিত হতেন।

বৈঠক শেষে মাহমুদুর রহমান মান্নার কাছে জানতে চাইলে তিনি এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমরা এসেছি কথা বলতে। আমরা তো আমাদের কথা বলবই। কিন্তু সিইসি কীভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য দেন? আমি বলেছি, আমি চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলছি আমি ম্যানিপুলেট দেখিয়ে দেব। তখন সিইসি বলে উঠলেন, আপনারা তো বড় বড় কথা বলেন। সেই সময় আমি বলেছি, মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ।

বৈঠক সূত্রে আরো জানা যায়, বৈঠকের একপর্যায়ে প্রতিনিধি দলের  সদস্য ডাকসুর সাবেক ভিপি ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সুলতান মোহাম্মদ মুনসুর আহমেদ সম্প্রতি শেষ হয়ে যাওয়া সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। সেই সময় তিনি বলেন, এক জেলার নেতা অন্য জেলার হাজতখানায়, পোলিং এজেন্টদের ভোট কক্ষ থেকে বের করে দেওয়া এবং কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হুমকি-ধমকি দেওয়া এভাবে তো চলতে পারে না। বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি বলে উঠেন, ২০১৯ সালের জানুয়ারির পরেও নির্বাচন কমিশনকে এই দেশে থাকতে হবে। সুতরাং সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে আপনারা নির্বাচন করবেন বলে আমি আশা রাখি।

যদিও একজন নির্বাচন কমিশনার ‘দেশে থাকার কথা বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচন সম্পন্ন করার কথা’র মতো বিষয়টিকে অস্বীকার করে এনটিভি অনলাইনকে বলেছেন, এমন ঘটনা তো আমি শুনিনি। তবে ভেতরে হট্টগোলের পরিস্থিতি তৈরি করেছে ঐক্যফ্রন্টের দুজন। একজন মান্না আর অপরজনকে চিনি না। উনি বোধ হয় ডাকসুর ভিপি ছিলেন। যাইহোক পরে নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন কথা না বললে তারা আরো উত্তপ্ত করতে পারত।

এরপর বৈঠক শেষে জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০১৯ সালের জানুয়ারির পরেও এই নির্বাচন কমিশনকে, আমাদেরকে এই দেশে থাকতে হবে। আমরা বলেছি, আপনারা সেইভাবে কাজ করবেন যাতে করে ২০১৯ সালের জানুয়ারির পরও দেশে থাকবেন, সেই কথা যেন মনে থাকে।’

এরপরে সংবাদ সম্মেলনে এসে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় নয়, তারা রাজনৈতিক নেতা, তাদের গলার আওয়াজ এমনই ছিল।

আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। ছবি : এনটিভি

আ স ম আবদুর রব সাংবাদিকদের আরো বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে প্রথম কথাটা আমরা বলেছি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে ৭ নভেম্বর সকাল ১১টায় সংলাপের পূর্বে এবং সংলাপের ফলাফল না জেনে নির্বাচন কমিশন যেন কোনো তফসিল ঘোষণা না করে। ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত পার্লামেন্টের মেয়াদ আছে। আমার মনে হয় অনেক সময় এখনো আছে। এর পূর্বে প্রত্যেকটা সরকারের আমলে তফসিল বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে নির্বাচন কমিশনে। অতএব, এইবারও তফসিল একবারে অত তারিখে ঘোষণা করতে হবে, নাহলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে, নির্বাচন হবে না-এমন কোনো ব্যাপার নেই।

জেএসডি সভাপতি বলেন, তফসিল পেছানোর বিষয়ে নির্বাচন কমিশন আমাদের প্রস্তাব বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছে। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি বিবেচনায় রাখার কথা বলেছেন।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা বলেন, তফসিল ঘোষণা, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার ও সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে ইসি তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। সেনা মোতায়েন প্রসঙ্গে সিইসি আমাদের বলেছে, ‘আমরা একবারও বলিনি সেনা মোতায়েন করা হবে না। তার অর্থ হলো নির্বাচনে সেনাবাহিনী থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। আমরা বলেছি, অতীতের মতো নির্বাচনে সেনাবাহিনী রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে রাখলে হবে না। সেনাবাহিনীকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনে মোতায়েন করতে হবে। তবে এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

আ স ম আবদুর রব জানান, বৈঠকে আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি বিষয় তাৎক্ষণিক মেনে নিয়েছে ইসি। মেনে নেওয়া বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে পোলিং এজেন্টদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে। নির্বাচনের ফল ঘোষণার যে নীতিমালা আছে, রিটার্নিং কর্মকর্তা ও পোলিং কর্মকর্তা যেভাবে সিল মেরে, স্বাক্ষর করে ফল ঘোষণা করে কিন্তু এবার সেটা পোলিং এজেন্ট পর্যন্ত দিতে হবে। ফলাফলে পোলিং এজেন্টদের স্বাক্ষরও থাকতে হবে। কারণ অনেক সময় কারচুপির জন্য পোলিং এজেন্টদের স্বাক্ষর আগে নিয়ে নেওয়া হয়। ফল গণনার আগে এজেন্টদের স্বাক্ষর নেওয়া যাবে না। এসব বিষয়ে কমিশন আমাদের তাৎক্ষণিক আশ্বস্ত করেছে।

নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার দাবি জানিয়ে রব বলেন, ইভিএম ব্যবহার দেশের জনগণ অর্থাৎ ভোটাররা চায় না। আমরা, কোনো রাজনৈতিক দলও চায় না। আমরা বলেছি, ইভিএমে ভোট ম্যানুপুলেশনের সুযোগ আছে। ইভিএম ব্যবহার করা হবে কি না- সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কিছু বলেনি। তবে তারা দাবি করেছে, এতে ম্যানুপুলেশনের সুযোগ নেই।

আজ সোমবার বিকেলে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। ছবি : এনটিভি

এ সব ব্যাপারে হেলালুদ্দীন আহমদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা বলেছেন ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের সংলাপ হবে। তারা অনুরোধ করেছেন, নিবাচন কমিশন যাতে লক্ষ্য রাখে। এর পর যাতে তফসিল ঘোষণা করা হয়। যেহেতু তফসিল ঘোষণার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের, তাই কমিশন সেটা খেয়াল করে দেখবে, আগামী ৮ তারিখের বৈঠকে সংলাপের ফলাফল প্রতিফলিত হতে পারে। তবে এখন ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি রয়েছে ইসির।

তফসিল পেছানোর সম্ভাবনা আছে কি না জানতে চাইলে ইসি সচিব বলেন, এই মুহূর্তে কিছু বলা যাচ্ছে না। ৮ নভেম্বর সকাল ১০টায় কমিশন সভা হবে। ওই সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, বৈঠকে সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন। সিইসি তাদের জানিয়েছেন, এখনো তফসিল ঘোষণা হয়নি। তফসিলের পর নির্বাচন কমিশনাররা বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

হেলালুদ্দীন বলেন, তাদের দাবি অনুযায়ী কেন্দ্রে কেন্দ্রে যে রেজাল্ট দেওয়া হবে, সেজন্য পোলিং এজেন্টদের স্বাক্ষর গ্রহণ করে ফলাফল প্রকাশ করা হবে। তাদের সঙ্গে আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়েও তাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে।

ইভিএম বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে ইসি সচিব বলেন, কমিশন বলেছে সীমিত পরিসরে শহর এলাকায় ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে সেটা কোন কোন কেন্দ্রে ব্যবহার হবে তা পরে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, নির্বাচন কমিশন একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেটি সাংবিধানিক ও আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা করে থাকে।  ঐক্যফ্রন্ট বলেছে, নির্বাচন কমিশনের প্রতি আমাদের আস্থা আছে। সেজন্যই তারা এখানে এসেছেন। অত্যন্ত আন্তরিকভাবে আলোচনা করেছেন।

তফসিলের তারিখ পেছালে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব কি না এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, আমাদের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি রয়েছে। ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতিও রয়েছে। তারা নির্বাচন পেছাতে বা আগাতেও বলেননি। নির্বাচন কমিশন সবকিছু বিবেচনা করেই ৮ তারিখ তফসিলের তারিখ ঠিক করেছে।