‘আমি শুধু পুলিশ না, একজন মানুষও’

Looks like you've blocked notifications!
রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে এক বৃদ্ধার জন্য রক্ত দিচ্ছেন পাংশা থানার এসআই হাফিজুর রহমান। ছবি : এনটিভি

নিঃসন্তান রাজিয়া বেগম ৫০ বছর পার করেছেন অনেক আগে। অসুস্থতায় শয্যাশায়ী বেশ কিছুদিন ধরে। পরিচর্যা আর সেবার অভাবে ভুগছেন রক্তশূন্যতায়। শনিবার বিকেলে রাজমিস্ত্রী স্বামী ইউনুছ মৃধা ও নিকট আত্মীয়স্বজনরা তাঁকে ভর্তি করেন রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে। 

কর্তব্যরত চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাজিয়া বেগমকে জরুরি ভিত্তিতে পাঁচ ব্যাগ ‘এবি’ পজিটিভ রক্ত দিতে বলেন। স্বজনরা তাঁকে রক্ত দিতে নিজ নিজ শরীরের রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করান। তাঁদের রক্তের গ্রুপ না মেলায় দ্বারস্থ হন বিভিন্ন ব্যক্তি ও রক্ত সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে। সারা রাত পার হলেও এবি পজিটিভ রক্ত মেলেনি কোথাও। 

এদিকে রাজবাড়ীর পাংশা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হাফিজুর রহমান (হাফিজ) গতকাল রোববার সকালে পাংশা থেকে যাচ্ছিলেন দৌলতদিয়া ঘাট এলাকায় ঈদে ঘরমুখো মানুষের কর্মস্থলে ফেরার দায়িত্ব পালন করতে।

রাজবাড়ীতে যাত্রাবিরতি করার সময় এই প্রতিনিধির কাছে তিনি ওই বৃদ্ধার জরুরি রক্তের বিষয়টি জানতে পারেন। তিনি জানান, তাঁর রক্তের গ্রুপও এবি পজিটিভ। তিনি রক্ত দিতে আগ্রহী। এরপর রোগীর স্বজনদের জানানো হয়, রক্ত দিতে আগ্রহী একজনকে পাওয়া গেছে। তিনি রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে যাচ্ছেন রক্ত দিতে। 

ওদিকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের বারান্দায় রক্তদাতার অপেক্ষায় প্রহর গুনতে থাকেন রাজিয়া বেগমের স্বজনরা। এসআই হাফিজুর রহমান যখন হাসপাতালে পৌঁছান, পুলিশের পোশাক পরা দেখে সবাই বলে ওঠেন, ‘উনি তো দারোগা।’

বলা হলো, ‘উনিই রক্ত দেবেন।’ কারো মুখে কোনো কথা নেই তখন।

এসআই হাফিজুর রহমানকে নিয়ে যাওয়া হলো প্যাথলজি বিভাগে রক্ত দিতে। প্যাথলজি বিভাগের কর্মীরা ঈদের ছুটি শেষে না আসায় প্রচণ্ড চাপ পড়ে দায়িত্বরত ব্যক্তির ওপর। তাঁকে জানানো হলো রক্ত দিতে একজনকে পাওয়া গেছে। উনি বললেন, বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। জনবল সংকট রয়েছে। 

ওনাকে বোঝানো হলো রক্ত দিতে আগ্রহী একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে পাওয়া গেছে। জরুরি ভিত্তিতে রক্ত নেওয়া শেষ করে তাঁকে দৌলতদিয়া ঘাটে দায়িত্ব পালন করতে যেতে হবে। ব্যাপারটি বুঝে প্যাথলজির কর্মকর্তা তাঁর পাশের কক্ষে নিয়ে গেলেন এবং একটি খালি রক্তের ব্যাগে পোশাক পরা পুলিশ কর্মকর্তার শরীর থেকে রক্ত নেওয়া শুরু করলেন। 

এমন সময় পাশ থেকে বৃদ্ধার এক স্বজন বলে উঠলেন, ‘পেটের গোস্ত গোস্ত না; পুলিশ কারো দোস্ত না’ আপনার এই রক্ত দেওয়া দেখে আপনাদেরই মুখের কথা আজ মিথ্যা প্রমাণ হলো। পুলিশও যে কারো দোস্ত হতে পারে, পুলিশও যে একজন নিঃসন্তান মায়ের সন্তান হতে পারে, আপনার রক্ত দেওয়া দেখে স্যালুট জানাই আপনাকে। আপনার পুলিশ বিভাগকে।’

কথাটি শোনার পরই এসআই হাফিজুর রহমানের মুঠোফোন নিয়ে একটি ছবি তোলা হয়। ছবি তোলার সময় এসআই হাফিজুর রহমান বলেন, ‘ভাই, আমি শুধু পুলিশ না। একজন মানুষও।’

রক্ত দেওয়ার পর এসআই হাফিজ দ্রুত তাঁর দায়িত্ব পালন করতে চলে যান। রক্ত দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর বৃদ্ধার শরীরে দেওয়া হয়। 

আরো রক্তের প্রয়োজনীয়তার কথা শুনে এসআই হাফিজ তাঁর এক সহকর্মীকে রক্ত দেওয়ার অনুরোধ করেন। শিক্ষানবিশ উপপরিদর্শক (পিএসআই) জয়ন্ত কুমার মজুমদার আজ সোমবার সদর হাসপাতালে গিয়ে ওই বৃদ্ধার জন্য এক ব্যাগ রক্ত দেন। জয়ন্তের অনুরোধে রক্ত দেন গৌরাঙ্গ কর্মকার নামের একজন। এ ছাড়া আজ জিয়া নামের এক ছাত্র ওই বৃদ্ধার জন্য এক ব্যাগ রক্ত দেন।     

ওই বৃদ্ধার শারীরিক অবস্থার ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) আবদুল হান্নান জানান, ওই বৃদ্ধাকে শনিবার সন্ধ্যায় মুমূর্ষু অবস্থায় সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

হিমোগ্লোবিন কম থাকায় জরুরিভাবে তাঁকে পাঁচ ব্যাগ রক্ত দিতে বলা হয়। এরই মধ্যে দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি কিছুটা সুস্থ। আরো রক্ত দেওয়ার পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।