ভোট ঘিরে এই প্রথম রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিষেধাজ্ঞা, কেন?
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রোহিঙ্গারা কোনো গোষ্ঠী বা প্রার্থীর পক্ষে প্রচার বা কেন্দ্রে গিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে না পারে সেজন্য সতর্ক অবস্থায় রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ক্যাম্পে অতিরিক্ত পুলিশ, আনসার ও সেনাবাহিনী নিয়োজিত রয়েছে।
রোহিঙ্গারা যেন ক্যাম্পের বাইরে আসতে না পারে সেজন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে। আজ শনিবার থেকে রোহিঙ্গারা যেমন ক্যাম্পের বাইরে আসতে পারবে না, ঠিক একইভাবে ক্যাম্পেও কেউ প্রবেশ করতে পারবে না। এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে ভোটের পরের দিন পর্যন্ত।
কক্সবাজার জেলা রিটার্নিং অফিসার ও জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামাল হোসেন গণমাধ্যমকে জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আজ শনিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৩১ ডিসেম্বর সকাল ৮টা পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের কাম্পের বাইরে না যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
কমিশনের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের যেন নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর পক্ষে বা বিপক্ষে কেউ ব্যবহার করতে না পারে বা তাঁরা যেন কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে। এ ছাড়া কোনো দুষ্কৃতকারী যেন তাদের ব্যবহার করতে না পারে সেজন্য বিশেষ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।’
‘এ লক্ষ্যে কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী যেন ২৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৩১ ডিসেম্বর সকাল ৮টা পর্যন্ত ক্যাম্পের বাইরে যেতে না পারে বা অন্য কোথাও যেতে না পারে সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ইসি সিদ্ধান্ত দিয়েছে।’
একইসঙ্গে এই সময় পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কোনো এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবীকর্মী গাড়ি নিয়ে ঢুকতে বা বের হতে না পারেন সেই নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। তবে খাদ্য, ত্রাণ বা জরুরি স্বাস্থ্যসেবা কাজে ক্যাম্পে প্রবেশের ক্ষেত্রে এই নির্দেশনা শিথিল থাকবে বলে কমিশনের চিঠিতে জানানো হয়েছে।
উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প ৫-এর রোহিঙ্গা মাঝি মো. আইয়ুব আলী জানান, ২৯ ডিসেমস্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে যাতে না যায়, সেটা সবখানে বলে দেওয়া হয়েছে।
উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কমিটির সাধারণ সম্পাদক গফুর উদ্দিন চৌধুরী জানান, এর আগে ২০১৪ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে বের না হতে কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। তখনো নানাভাবে রোহিঙ্গারা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করেছে। এবারও নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর থেকে রোহিঙ্গারা দলবদ্ধ হয়ে ক্যাম্পের বাইরে চলে আসে। অনেকে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করে এমনকি অনেকে নির্বাচনী প্রচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
নির্বাচন কমিশন রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে বের না হতে যে তিনদিনের নির্দেশনা দিয়েছে তা আরো বাড়ানো প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন এই ইউপি চেয়ারম্যান। তিনি আরো বলেন, নির্দেশনা না থাকায় রোহিঙ্গারা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে প্রচারের সুযোগ পেয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের কারণে যে কোনো বড় ধরনের সহিংতার আশংকা করা হচ্ছে।
কক্সবাজার বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আয়াছুর রহমান জানান, মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা নির্যাতনের ফলে পালিয়ে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা। এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বন ও পাহাড় কেটে ছোট-বড় ৩০টি ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। এর মধ্যে অনেক রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৭৮-৭৯ সালে আসা রোহিঙ্গাদের অনেকে এরই মধ্যে বাংলাদেশের ভোটার তালিকাভুক্ত হয়েছে। নাশকতার কাজে রোহিঙ্গাদের ব্যবহারের বিষয়টি উড়িয়ে দেননি আয়াছুর।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন জানান, ইসি তিনদিনের জন্য বিশেষ নির্দেশনা দিলেও আগে থেকে উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ ব্যাপারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
ক্যাম্পের চারপাশে নয়টি পয়েন্ট ও প্রধান সড়কের তিনটি পয়েন্টে চেকপোস্ট থাকবে। ক্যাম্পে অতিরিক্ত ৪৮০ জন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। তিনদিন ক্যাম্পের ভিতরে রাস্তায় আটটি টহল টিমের পাশাপাশি সেনাবাহিনী, আনসার, নির্বাহী হাকিমের নেতৃত্বে মোবাইল টিম পরিচালিত হবে।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম জানিয়েছেন, এ বিষয়ে রোহিঙ্গাদের সতর্ক করার পাশাপাশি সব ক্যাম্পের মাঝিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থাসহ সব সংস্থার কর্মকর্তাদেরও এটা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। জরুরি চিকিৎসাসহ একেবারেই অপরিহার্য প্রয়োজন ছাড়া কেউ যাতে ক্যাম্পে প্রবেশ বা বাহির হতে না পারে সে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
কমিশনার আরো জানান, নির্বাচন উপলক্ষে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের যে কড়া নির্দেশনা রয়েছে সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হচ্ছে। পাশাপাশি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুলিশ, বিজিবি, র্যাব ও আনসার বাহিনীর সদস্যরা টহল দিয়ে যাচ্ছে।
নির্বাচনকে ঘিরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিশৃঙ্খলা বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটার মতো কোনো কিছুই নজরে আসেনি বলে জানান জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন।
কক্সবাজারে চারটি সংসদীয় আসনে ২৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। জেলার চারটি সংসদীয় আসনে চারটি পৌরসভা ও ৭১টি ইউনিয়নে ভোটার সংখ্যা ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ২০৪ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ছয় লাখ ৫৭ হাজার ৩৭৩ জন এবং পুরুষ ভোটার সাত লাখ সাত হাজার ৮৩১ জন।