মৌলভীবাজারে ৩ দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা শুরু
প্রতি বছরের মতো এবারও পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মৌলভীবাজারের শেরপুর এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পাড়ে প্রায় ২০০ বছর ধরে চলা ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা শুরু হয়েছে। তিন দিনব্যাপী মেলায় হাওর ও নদীতে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা দেশীয় প্রজাতির টাটকা মাছ কিনতে বিভিন্ন স্থান থেকে ক্রেতারা ও পাইকাররা ভিড় জমাচ্ছেন। তবে মেলার আয়োজকদের দাবি, মেলার জন্য স্থায়ীভাবে যাতে স্থান নির্ধারণ করা হয়।
মৌলভীবাজার, সিলেট ও হবিগঞ্জের সীমানা ঘেষে জেলার শেরপুর এলাকায় বসে প্রতি বছর মাছের মেলা। আর এ অঞ্চলের মানুষ অধীর আগ্রহে থাকে কখন বছর ঘুরে শুরু হবে মাছের মেলা। এ বছর মেলায় এক লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের বাঘাইড় মাছ উঠেছে।
পৌষ সংক্রান্তি উপলক্ষে মাছের মেলাটি শুরু হলে এটি এখন সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে। রোববার রাত থেকে শুরু হওয়া তিন দিনব্যাপী এই মেলা শেষ হবে কাল মঙ্গলবার দুপুরে।
মেলায় আগত ক্রেতারা জানায়, হাওর ও নদীতে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠা মাছ ও দেশীয় প্রজাতির টাটকা ফরমালিন মুক্ত মাছ পাওয়ায় মেলায় মাছ কিনতে আসে অনেকে। তবে মেলায় পছন্দের মাছ বিপুল পাওয়া গেলেও মূল্য অনেকটা বেশি বলে মন্তব্য করেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী আর এস লকনু চৌধুরী। একই ধরনের বক্তব্য জানালেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী সৈয়দ ছাব্বির আহমদ।
মৌলভীবাজারের শেরপুর এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পাড়ে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলায় মাছ নিয়ে বিক্রেতা। ছবি : এনটিভি
মেলার পাশের এলাকা আইনপুরের সাবু মিয়া জানান, নদী ও হাওর থেকে আসা টাটকা মাছ কিনতে প্রতি বছর মাছের মেলার অপেক্ষায় থাকেন। তিনি মাছ কিনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আত্মীয়স্বজনদের আমন্ত্রণ করে এক সঙ্গে খাবারের আয়োজন করেন।
মাছ বিক্রেতারা জানায়, হাওর ও নদীতে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা মাছ সাধারণত নিয়ে আসেন এই মেলায়। মেলা উপলক্ষে মাছের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় বেশি মূল্যে মাছ সংগ্রহ করতে হয় তাদের।
শেরপুর এলাকার স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ী আবদুল আলিম জানান, একটি বাঘাইড় মাছ মেলায় নিয়ে এসেছেন। এক লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্য চাচ্ছেন। ৮৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম উঠেছে। ৯০ হাজার টাকা বললে ছেড়ে দেবেন।
মাছ ব্যবসায়ী জাকির মিয়া জানান, ১০ লাখ টাকার মাছ নিয়ে এসেছেন মেলায়। এগুলো হাওর ও নদী থেকে সংগৃহীত টাটকা মাছ।
রাজশাহী থেকে আসা মাছ ব্যবসায়ী মো. শরিফুল ইসলাম জানান, প্রায় ২৫ লাখ টাকার রুই, কাতলা ও ব্রিগেট মাছ নিয়ে এসেছেন এ মাছের মেলায়। এসব মাছ গত ৩ বছর থেকে খামারে পরিচর্যায় বড় করে মেলায় নিয়ে আসেন।
মৌলভীবাজারের শেরপুর এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পাড়ে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলায় মাছ নিয়ে বিক্রেতা। ছবি : এনটিভি
একই ধরনের মন্তব্য করে সিরাজগঞ্জ থেকে আসা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, তিনিও প্রায় ১২ লাখ টাকার মাছ নিয়ে এসেছেন মেলায়। প্রথম দিনে চার লাখ টাকার মাছ বিক্রি করেছেন।
মেলায় পাশের কুশিয়ারা নদী, হাকালুকি হাওর, কাওয়াদীঘি হাওর, হাইল হাওর ও সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মৎস্য ব্যবসায়ীরা রুই, কাতলা, বোয়াল, গজার, বাঘাইড় ও আইড় মাছসহ বিশাল আকৃতির মাছ নিয়ে আসেন মেলায়।
মাছের মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি মো. অলিউর রহমান জানান, গত তিন থেকে চার বছর ধরে জুয়াসহ যাত্রা ও পুতুল নাচের নামে অশ্লীলতা বন্ধ হয়ে শুধু মাছের মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ফিরে পেয়েছে। এ ছাড়া প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা রাজস্ব সরকারকে তারা দিলেও মেলার জন্য এখনো স্থায়ী কোনো স্থান গড়ে উঠেনি। দীর্ঘদিন থেকে কুশিয়ারা নদীর তীর ঘেষে চলে আসা মেলার স্থানটি ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দেওয়ায় মেলা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে ব্যাঘাত হচ্ছে। তিনি ঐতিহ্যবাহী এ মাছের মেলা টিকিয়ে রাখার জন্য স্থায়ীভাবে স্থান নির্ধারণের দাবি করেন।
এটি মাছের মেলা নামে পরিচিত হলেও মাছ ছাড়াও ফার্নিচার, গৃহস্থালী সামগ্রী, খেলনা সামগ্রীসহ গ্রামীণ ঐতিহ্যের দোকান রয়েছে। বর্তমানে এই মাছের মেলা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার মিলনমেলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
মৌলভীবাজারের শেরপুর এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পাড়ে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলায় মাছ নিয়ে বিক্রেতা। ছবি : এনটিভি