থেমে গেল সুর, হবে না আর গান

Looks like you've blocked notifications!
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। পুরোনো ছবি : এনটিভি

প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আর নেই। আজ মঙ্গলবার ভোরে রাজধানীর আফতাবনগরের নিজ বাসায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিরীন শারমিন চৌধুরী। তাঁরা পৃথক বাণীতে মরহুমের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এনটিভির সংগীতবিষয়ক জনপ্রিয় রিয়েলিটি শো ক্লোজআপ ওয়ানের বিচারক ছিলেন। তাঁর মরদেহ রাখা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হিমঘরে। কাল বুধবার বেলা ১১টায় সর্বসাধারণের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে। সেখানে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মরদেহ থাকবে। তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মান গার্ড অব অনার দেওয়া হবে। এর পর জোহর নামাজের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে তাঁর জানাজা হওয়ার কথা আছে।

তবে দাফনের ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ জানান, এ ব্যাপারে একমাত্র ছেলের সঙ্গে কথা বলে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

রাজধানীর আফতাবনগরের বাসায় সংগীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহ। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের ব্যক্তিগত সহকারী রোজেন বলেন, ‘ভোর ৪টার দিকে স্যার আমাকে ফোন দিয়ে জানান, তাড়াতাড়ি বাসায় আসো, আমার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। এরপর ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে আমি স্যারের বাসায় যাই। কিন্তু কোনো পালস পাইনি। পরে মহাখালীর আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতালে (বর্তমান নাম ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) নিয়ে যাই। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা তাঁকে সাড়ে ৫টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন।’

২০১৮ সালের মাঝামাঝি সময়ে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের হৃৎপিণ্ডে আটটি ব্লক ধরা পড়ে। পরে তাঁর শারীরিক অবস্থার কথা জানতে পেরে চিকিৎসার দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নেওয়ার পর বুলবুলকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। সেখানে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসকরা বুলবুলের বাইপাস সার্জারি না করে শরীরে রিং পরানোর সিদ্ধান্ত নেন। এর পরে তাঁর শরীরে দুটি স্টেন্ট (রিং) স্থাপন শেষে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেন তিনি।

প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭০ দশকের শেষলগ্ন থেকে আমৃত্যু বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পসহ সংগীতশিল্পে সক্রিয় ছিলেন।

রাজধানীর আফতাবনগরের বাসায় অ্যাম্বুলেন্সে সংগীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহ। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ২০১২ সালের ৪ অক্টোবর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের ১৪তম সাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেন।

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল নিয়মিত গান করেন ১৯৭৬ সাল থেকে। ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলী বাদল’ ছবিতে সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। এরপর তিন শতাধিক চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করে দুবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। প্রথমটি ছিল ২০০১ সালে ‘প্রেমের তাজমহল’ আর দ্বিতীয়টি ছিল ২০০৫ সালে ‘হাজার বছর ধরে’ ছবির জন্য। এ ছাড়া তিনি রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, রাষ্ট্রপতির পুরস্কার, ১১ বার বাচসাস পুরস্কার, সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস, শহীদ আলতাফ মাহমুদ পদক-২০১৪সহ অন্যান্য অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন।

চিরদিন বাজবে মানুষের বুকে

অসংখ্য গানে সুর করেছেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, যার অধিকাংশ গানই তাঁর নিজের রচিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গান হলো :

দেশাত্মবোধক গান : সব কটা জানালা খুলে দাও না, ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে, সেই রেললাইনের ধারে, সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য, ও আমার আট কোটি ফুল দেখ গো মালি, মাগো আর তোমাকে ঘুমপাড়ানি মাসি হতে দেব না, একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না, মাগো আর নয় চুপি চুপি আসা, সালাম বাংলাদেশ, জাগো বাংলাদেশ জাগো, জীর্ণ দেহের এক বৃদ্ধা নারী, I am a war child ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা।

রাজধানীর আফতাবনগরের বাসায় অ্যাম্বুলেন্সে সংগীত পরিচালক, গীতিকার, সুরকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মরদেহ। ছবি : মোহাম্মদ ইব্রাহিম

বুলবুলের সুরারোপ করা উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের গান হলো : আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি (নয়নের আলো), আমার বুকের মধ্যিখানে (নয়নের আলো), আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন (নয়নের আলো), আমি তোমার দুটি চোখে দুটি তারা হয়ে থাকব (নয়নের আলো), আমি তোমারি প্রেমও ভিখারি, (চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা), ও আমার মন কান্দে, ও আমার প্রাণ কান্দে (চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা), আমার গরুর গাড়িতে বৌ সাজিয়ে (আঁখি মিলন), তোমায় দেখলে মনে হয়, হাজার বছর আগেও বুঝি ছিল পরিচয় (বিয়ের ফুল), ঐ চাঁদ মুখে যেন লাগে না গ্রহণ (বিয়ের ফুল), কত মানুষ ভবের বাজারে (লাভস্টোরি), বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম (তোমাকে চাই), আম্মাজান আম্মাজান (আম্মাজান), স্বামী আর স্ত্রী বানায় যে জন মিস্ত্রি (আম্মাজান), তোমার আমার প্রেম এক জনমের নয় (আম্মাজান), আমার জানের জান আমার আব্বাজান (আব্বাজান), ঈশ্বর আল্লাহ বিধাতা জানে (আব্বাজান), এই বুকে বইছে যমুনা (প্রেমের তাজমহল), আমি জীবন্ত একটা লাশ (ইতিহাস), প্রেম কখনো মধুর, কখনো সে বেদনাবিধুর (মহৎ), পড়ে না চোখের পলক (প্রাণের চেয়ে প্রিয়), যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে (প্রাণের চেয়ে প্রিয়), অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে (লুটতরাজ), তুমি আমার জীবন, আমি তোমার জীবন (অবুঝ হৃদয়), তুমি হাজার ফুলের মাঝে একটি গোলাপ (মন মানে না), জীবনে বসন্ত এসেছে, ফুলে ফুলে ভরে গেছে মন (নারীর মন), ঘুমিয়ে থাকো গো সজনী (নারীর মন), আমার হৃদয় একটা আয়না (ফুল নেব না অশ্রু নেব), বিধি তুমি বলে দাও আমি কার (ফুল নেব না অশ্রু নেব), তুমি মোর জীবনের ভাবনা, হৃদয়ে সুখের দোলা (আনন্দ অশ্রু), তুমি আমার এমনই একজন, যারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না এ মন (আনন্দ অশ্রু), একাত্তরের মা জননী কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল (বিক্ষোভ), বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয় এখানে সভ্যতারই ফুল ফোটানো হয় (বিক্ষোভ), এই জগৎ সংসারে তুমি এমনই একজন (তেজী), জীবন ফুরিয়ে যাবে ভালোবাসা ফুরাবে না জীবনে (বিদ্রোহ চারিদিকে), পৃথিবী তো দুদিনেরই বাসা, দুদিনেই ভাঙে খেলাঘর (মরণের পরে), অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন (ভালবাসি তোমাকে), ওগো সাথি আমার তুমি কেন চলে যাও (আমার অন্তরে তুমি), তুমি সুতোয় বেঁধেছ শাপলার ফুল নাকি তোমার মন (হাজার বছর ধরে), একদিন দুইদিন তিনদিন পর, তোমারি ঘর হবে আমারি ঘর (মহামিলন), গানে গানে চেনা হলো (না বোলো না), নদী চায় চলতে, তারা যায় জ্বলতে (না বোলো না)।

এ ছাড়া বুলবুল অনেক আধুনিক গানে সুরারোপ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : ও ডাক্তার,ও ডাক্তার, আমার তুমি ছাড়া কেউ নেই আর, তুমি কত লিটার দুধ করেছ পান, আপামর জনতার ধারণা, যোজন যোজন দূর, শেষ ঠিকানায় পৌঁছে দিয়ে আবার কেন পিছু ডাকো, চিঠি লিখেছে বউ আমার, আট আনার জীবন, বুকটা আমার ভাঙা বাড়ি, আম্মা ভিক্ষা দেন নইলে ভিক্ষা নেন, আমার দুই চোখে দুই নদী, আমি জায়গা কিনবো।