নদী দখলকারীকে সব নির্বাচন ও ব্যাংক ঋণে অযোগ্য ঘোষণা

Looks like you've blocked notifications!

নদী দখলকারীকে ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) থেকে জাতীয় সংসদসহ সব নির্বাচনে অযোগ্য এবং ব্যাংক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট।

এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া নদী রক্ষায় ১০টি নির্দেশনা দিয়ে রায় দিয়েছেন আদালত।

তুরাগ নদ রক্ষা সংক্রান্ত রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে আজ রোববার বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন।

আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল পূরবী রানী শর্মা ও পূরবী সাহা।

তুরাগ নদকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে দেশের সব নদ-নদী-খালের আইনগত অভিভাবক ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। দেশের সব নদ-নদী-খাল-জলাশয় ও সমুদ্র সৈকতের সুরক্ষা এবং তার বহুমুখী উন্নয়নে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বাধ্য থাকবে বলেও রায়ে উল্লেখ করেন আদালত।

নির্দেশনায় আদালত নদী দখলকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে কঠিন সাজা ও জরিমানা নির্ধারণ করে অভিযোগ দায়ের, তদন্তের ব্যবস্থা রেখে ২০১৩ সালের নদী রক্ষা আইন সংশোধন করে ছয় মাসের মধ্যে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলেছেন।

এ ছাড়া নদী রক্ষা কমিশন আইনের যেসব সংশোধন প্রস্তাব করেছে, তা অনতিবিলম্বে বিবেচনা করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।

নদী রক্ষা কমিশনকে একটি স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

প্রতিরোধমূলক নির্দেশনায় আদালত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই মাসে একদিন এক ঘণ্টা করে নদী দূষণের ওপর সচেতনতামূলক ক্লাসের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিয়েছেন। বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পাশাপাশি দেশের বড়, মাঝারি ও ছোট শিল্পকারখানার শ্রমিকদের অংশগ্রহণে দুই মাস পরপর একদিন এক ঘণ্টা করে নদী বিষয়ে বৈঠক অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়টি তদারকি করতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া স্থানীয় ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা, বিভাগীয় পর্যায়ে তিন মাস অন্তর এক দিনব্যাপী নদী বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে সব অবৈধ নদী দখলদারদের নাম প্রকাশ করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিষয়টি চলমান তদারকিতে থাকবে বলে রায়ে বলেন আদালত। রায়ের অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাতেও বলা হয়েছে, যাতে তিনি নদ-নদীর বিষয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে পারেন।

মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়া তুরাগ তীরে থাকা ১৪ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে তাদের স্থাপনা ৩০ দিনের মধ্যে নিজ খরচে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। অন্যথায়, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ওই সব ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের খরচায় উচ্ছেদের ব্যবস্থা করবে।

এর আগে গত বুধবার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, ‘দেশে শত শত নদ-নদী রয়েছে। এসব নদী দখলকে কেন্দ্র করে পৃথক পৃথক মামলা হয়, পৃথক পৃথক আদেশ হয়। দখলদাররা ফের গিয়ে দখল করে, এমনটি চলতে দেওয়া যায় না। আমরা সব একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসতে চাই। নদ-নদী নিয়ে এসব কানামাছি খেলা বন্ধ হওয়া উচিত।’

আদালত বলেন, ‘আমাদের দেশের নদীগুলো জীবন্ত সত্তা। মানবজাতি টিকে থাকার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে নদী। বিভিন্ন দেশের সরকার আইন প্রণয়ন করে নদীকে বেদখলের হাত থেকে রক্ষার চেষ্টা করছে। ঢাকার আশপাশে বহমান চার নদী রক্ষায় এরই মধ্যে আদালত নানা গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু সেসব রায়ের নির্দেশনার সঠিক বাস্তবায়নে বিবাদীরা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তা নেওয়া হলে তুরাগ নদ রক্ষায় হাইকোর্টে আরেকটি মামলা করার প্রয়োজন হতো না। শুধু যে তুরাগ নদ আক্রান্ত তা নয়; পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত ৪৫০টি নদী অবৈধ দখলদারদের দ্বারা আক্রান্ত।’

আদালত বুধবার আরো বলেন, ‘এর আগে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের একটি রায় ও গাইডলাইনের আলোকে নদী কমিশন গঠিত হয়েছে। আইনও তৈরি হয়েছে। আমরা সেটি দেখে আরো কিছু গাইডলাইন দিয়ে রায় দেব।’

এ সময় আদালত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে মন্তব্য করে বলেন, ‘সাংবাদিকদের তথ্যবহুল প্রতিবেদনের আলোকেই আমরা সমাজের অনিয়মের কথা জানতে পারি। সাংবাদিকরা বংশীবাদকের মতো। নদী দখলসহ সব ধরনের অনিয়মের কথা সাংবাদিকরাই তুলে ধরেন। আমাদের দেশের সাংবাদিকতার অনেক উন্নয়ন দরকার।’

আদালত যুক্তরাষ্ট্রের রেফারেন্স দিয়ে বলেন, ‘দুই সাংবাদিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের আলোকে সে দেশের সরকার পতন হয়েছিল। আমাদের দেশেও সেই ধরনের এফেক্টিভ জার্নালিজম হওয়া দরকার। এতে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে।’

বুধবার দেওয়া রায়ে তুরাগ নদকে ‘লিগ্যাল পারসন’ বলে ঘোষণা করেন আদালত, যা দেশের সব নদ-নদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়।

রায়ে হাইকোর্ট বলেন, ‘অবৈধ দখলদারদের দ্বারা প্রতিনিয়তই দেশের কমবেশি নদী দখল হচ্ছে। অবৈধ স্থাপনা তৈরি করায় সংকুচিত হয়ে পড়ছে নদী। নাব্যতা ও বেদখলের হাত থেকে নদী রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশ তথা মানবজাতি সংকটে পড়তে বাধ্য। এসব বিষয় বিবেচনা করে তুরাগ নদকে লিগ্যাল/জুরিসটিক পারসন হিসেবে ঘোষণা করা হলো।’

এর আগে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে করা এক রিটে তুরাগ নদের অবৈধ দখলদারদের নাম ও স্থাপনার তালিকা হাইকোর্টে দাখিল করেছিল বিচার বিভাগীয় একটি তদন্ত কমিটি। ওই তদন্ত কমিটির দেওয়া তালিকায় আসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা পরে এ মামলায় পক্ষভুক্ত হন। পরে উভয় পক্ষের দীর্ঘ শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বুধবার রায় ঘোষণা শুরু করেন এবং আজ রোববার রায় ঘোষণা সমাপ্ত করেন।