ইয়াবা ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণ, কলঙ্কমোচন হবে কি?

Looks like you've blocked notifications!

অনেক জল্পনা-কল্পনার পর মাদক চোরাচালানের ‘স্বর্গরাজ্য’ হিসেবে পরিচিত কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে প্রশাসন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামালের উপস্থিতিতে আজ শনিবার সকাল ১০টায়  টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা আত্মসমর্পণ করবেন। এ নিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফসহ জেলার সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযানে ‘ক্রসফায়ারে’ প্রায় প্রতিদিনই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিহতের ঘটনার মধ্যে এই আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর থেকেই শতাধিক চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ী পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে হেফাজতে চলে যান।

আজ সেসব ইয়াবা ব্যবসায়ীর আত্মসমর্পণ সামনে রেখে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। এই আত্মসমর্পণের এর মধ্য দিয়ে টেকনাফবাসীর কলঙ্কমোচনের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তা কি ইয়াবা ব্যবসায়ী ও তাদের সহযোগীরা সত্যিকার অর্থেই কাজে লাগাবে; নাকি শুধু প্রাণ বাঁচানোর জন‍্যই আপৎকালে এই সুযোগকে কৌশলে ব্যবহার করবে?

এই প্রশ্ন উঠার কারণ, আত্বমসমর্পণের জন্য অনেক চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ীর নাম শোনা গেলেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তাদের সহযোগী, সাঙ্গপাঙ্গরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। তাদের আত্মসমর্পণের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

এদিকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে দম ফেলার ফুরসত নেই যেন পুলিশ প্রশাসনে। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় অনুষ্ঠানস্থল পরিদর্শন করছেন। কোথাও কোনো ত্রুটি যেন না থাকে সে চেষ্টা করছেন। তা ছাড়া নিরাপত্তার বিষয়টি তো রয়েছেই। টেকনাফ পাইলট হাই স্কুল মাঠে মঞ্চ ও প্যান্ডেল নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে, এলাকায় জোরেসোরে চলছে মাইকিং। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে অনুষ্ঠান সফল করতে সহযোগিতা কামনা করেছেন টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশ।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মো. জাবেদ পাটোয়ারী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন, জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন এতে উপস্থিত থাকবেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন জেলা পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেন। এ ছাড়া জেলার চার সংসদ সদস্য এতে উপস্থিত থাকবেন। জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে আত্মসমর্পণের এই অনুষ্ঠানটি হচ্ছে।

টেকনাফ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) এ বি এম এস দোহা জানান, সকালে কক্সবাজার পুলিশের তত্ত্বাবধানে থাকা শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ীকে অনুষ্ঠানস্থলে নিয়ে আসা হবে।

‘বদির তিনভাই, চার আত্মীয় সেফহোমে’

এদিকে শেষ মুহূর্তে নতুন করে আর কোনো ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণে যাচ্ছে কি না, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে কৌতূহলের শেষ নেই। এরই মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির আপন তিনভাই, ভাগিনা, ফুফাত ভাইসহ সাতজন আত্মসমর্পণের জন্য সেফহোমে রয়েছেন। তাঁরা আজকের অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণ করবেন।

আলোচনায় হাজি সাইফুল করিম

ইয়াবা কারবারের জন্য তালিকাভুক্ত সাইফুল করিম আত্মসমর্পণ করছেন কি না, তা নিয়েও নানা আলোচনা চলছে। সাইফুলের বাড়ি টেকনাফের শীলবুনিয়া পাড়ায়। অভিযান শুরুর পর পরই সাইফুল দেশ ছেড়ে মিয়ানমারে পালিয়ে যান বলে এলাকাবাসীর মধ্যে গুঞ্জন রয়েছে। তিনি আত্মসমর্পণের জন্য দেশে ফিরে এসেছেন এবং আজ আত্মসমর্পণ করবেন- এমন একটি খবর টেকনাফজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে সাইফুল করিম আত্মসমর্পণের জন্য জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে প্রতিনিধি পাঠিয়ে চেষ্টা চালিয়েছেন বলেও জানা গেছে। তবে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সাইফুল করিম সেফহোমে পৌঁছাননি বলে জানা গেছে।

‘অভিযানে কক্সবাজারেই নিহত ৪২’

অভিযান শুরুর পর জেলায় প্রায় প্রতিদিনই ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সন্দেহভাজন মাদক কারবারিদের হতাহতের ঘটনা ঘটছে। এ সময় ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শুধু কক্সবাজারেই ৪২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে টেকনাফ উপজেলাতেই নিহতের সংখ্যা ৩৯ জন। তাদের মধ্যে ২৫ জন টেকনাফের বিভিন্ন গ্রামের বাসিন্দা। রয়েছেন দুজন জনপ্রতিনিধিও।

সূত্র জানায়, ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করে। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে পথ খুঁজতে থাকে। একপর্যায়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেয়। এতে সরকার মাদক নির্মূলের জন্য ইয়াবা কারবারিদের আত্মসমর্পণের সুযোগ দিতে সম্মত হয়।

গত ১০ জানুয়ারি থেকে ইয়াবা কারবারিরা কক্সবাজার পুলিশের হেফাজতে চলে যায়। এরপর থেকে শুরু হয় দল বেঁধে আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া। এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে জানান দিয়ে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এনামুল হক সঙ্গীসাথীদের নিয়ে শো-ডাউনের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করেন।

আজ আত্মসমর্পণ করছে যারা

সূত্র জানিয়েছে, আজ শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করতে পারে। তাদের মধ্যে রয়েছে- টেকনাফ পৌরসভার চৌধুরী পাড়ার বাসিন্দা আবদুস শুক্কুর, শফিকুল ইসলাম শফিক, আমিনুর রহমান ওরফে আবদুল আমিন, ফয়সাল রহমান, সাবেক এমপি বদির ভাগনে সাহেদ রহমান নিপু, আরেক ভাগিনা টেকনাফ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নূরুল বশর ওরফে নূরশাদ, মং সিং থেইন ওরফে মমসি, ফুপাতো ভাই কামরুল হাসান রাসেল, মারুফ বিন খলিল বাবু, বেয়াই সাহেদ কামাল, টেকনাফ উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আলমের ছেলে দিদার মিয়া, টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার নুরুল হুদা, টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এনামুল হক এনাম মেম্বার, সাবরাং ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন দানু মেম্বার, হ্নীলা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের জামাল মেম্বার, সাবরাং ইউপির শাহপরীর দ্বীপের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার রেজাউল করিম রেজু মেম্বার, উত্তর আলী খালির শাহ আজম ও সাবরাং নয়াপাড়ার আলমগীর ফয়সাল লিটন, শীলাবুনিয়া পাড়ার হাজি সাইফুল করিমের দুই শ্যালক জিয়াউর রহমান ও আবদুর রহমান, টেকনাফের পশ্চিম লেদার নুরুল কবির, হ্নীলা সিকদারপাড়ার সৈয়দ আহম্মদ সৈয়দ, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত নাজিরপাড়ার জিয়াউর রহমানের ভাই আবদুর রহমান, নাজিরপাড়ার সৈয়দ হোসেন, নাইটংপাড়ার ইউনুস, ডেইলপাড়ার জাফর আলম, জাহাজপুরার নুরুল আলম, হ্নীলার রশিদ আহম্মদ ওরফে রশিদ খুলু, সদরের ডেইলপাড়ার আব্দুল আমিন ও নুরুল আমিন, টেকনাফ সদরের উত্তর লম্বরি এলাকার করিম মাঝি, হ্নীলা ফুলের ডেইলের রুস্তম আলী, শামলাপুর জুমপাড়ার শফিউল্লাহ, একই এলাকার সৈয়দ আলম, রাজাছড়ার আব্দুল কুদ্দুছ, মধ্যম জালিয়াপাড়ার মোজাম্মেল হক, জাহেলিয়াপাড়ার মোহাম্মদ সিরাজ, কচুবনিয়ার আব্দুল হামিদ, নাজিরপাড়ার মোহাম্মদ রফিক, পল্লানপাড়ার মোহাম্মদ সেলিম, নাইটংপাড়ার রহিমউল্লাহ, নাজিরপাড়ার মোহাম্মদ হেলাল, চৌধুরীপাড়ার মোহাম্মদ আলম, সদর ইউনিয়নের মৌলভীপাড়ার একরাম হোসেন, হ্নীলার পূর্ব পানখালির নজরুল ইসলাম, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের তুলাতলি এলাকার নুরুল বশর ওরফে কালা ভাই, হাতিয়ার ঘোনার দিল মোহাম্মদ, একই এলাকার হাসান, সাবরাং নয়াপাড়ার নূর মোহাম্মদ, কচুবনিয়ার বদিউর রহমান ওরফে বদুরান, জালিয়াপাড়ার জুবায়ের হোসেন, হ্নীলার পূর্ব লেদার জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ।