শখ থেকে সচ্ছলতা

Looks like you've blocked notifications!
কিশোরগঞ্জের ভৈরবে কবুতর আর পাখির খামারে নানা রংবেরঙের পাখি। ছবি : এনটিভি

কিশোরগঞ্জের ভৈরবে কবুতর আর পাখির খামার করে ভালো মুনাফা হওয়ায় এই পেশায় ঝোঁক বাড়ছে বেকার যুবকদের। অল্প পুঁজিতে, স্বল্প পরিসরে ও পারিবারিক পরিবেশে অধিক মুনাফা হওয়ায় বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই কবুতর আর পাখির খামার।

স্থানীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগের দাবি, অযথা চাকরির পেছনে না ছুটে শিক্ষিত-অশিক্ষিত যুবক-যুবতীরা নিজেদের এই পেশায় সম্পৃক্ত করে স্বাবলম্বী হতে পারেন। এই পেশায় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা ও নিয়মিত তদারকি করার আশ্বাসও দেন তাঁরা।

ভৈরবে যাঁরা এখন এই কবুতর ও পাখি পালনের পেশার সঙ্গে জড়িত, তাঁদের কেউই আগে এটাকে পেশা হিসেবে দেখেননি। নিতান্ত শখ বা নেশার বশেই কিনেছিলেন কবুতর ও পাখি। পরবর্তী সময়ে পেশা হিসেবে নেওয়ার মতো উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় তাঁরা সেই শখকেই বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। এখন তাঁরা অল্প পুঁজি ও শ্রমে ভালো মুনাফা পেয়ে আর্থিক সচ্ছলতায় জীবনযাপন করছেন।

একজনের সফলতায় অন্যজন উৎসাহিত হয়ে এই কাজকেই পেশা হিসেবে নিচ্ছেন এখানকার অনেকেই। ফলে এখানে দিন দিন বেড়েই চলছে রংবেরঙের দেশি-বিদেশি কবুতর ও পাখির খামার। আর এই খামারগুলো এখানকার গ্রামীণ অর্থনীতি, আমিষের ঘাটতি পূরণ ও মনোরঞ্জনে রাখছে দারুণ ভূমিকা।

পোষা প্রাণীদের মধ্যে কবুতর মানুষের অন্যতম প্রিয় একটি প্রাণী। আদিকাল থেকেই এ প্রাণীটিকে মানুষ ভালোবেসে পালন করে আসছে। আর তাই পৃথিবীর নানা ভাষায় একে নিয়ে অনেক কাহিনী, কাব্য ও গান রচনা হয়েছে। এর মধ্যে ডাকবাহক হিসেবে কবুতরের ভূমিকা নিয়েই রচিত হয়েছে অনেক সাহিত্য।

কিন্তু এ কবুতর পালন একসময় পেশায় পরিণত হবে, তা হয়তো তখন ভাবেনি মানুষ। এমনকি যাঁদের নিয়ে আজকের প্রতিবেদন, ভৈরবের এসব খামারির কেউ ভাবেননি কবুতর পালন তাঁদের জীবন-জীবিকায় পেশা হয়ে দাঁড়াবে।

প্রথমে এক থেকে দুই জোড়া কবুতর শখের বশে পালন শুরু করলেও আর্থিক লাভের দ্বার খুলে যাওয়ায় ধীরে ধীরে এটিকে পেশা হিসেবে নেন তাঁরা। ফলে দিন দিন এসব খামার বাণিজ্যিকভাবে প্রসারিত হচ্ছে। স্বল্প পরিসরে পরিবারের লোকজনদের শ্রমে এ খামার থেকে ভালো উপার্জন হওয়ায় একজনের সাফল্যে অন্যজন উৎসাহিত হয়ে খামার গড়ে তুলছেন। আর অল্প দিনেই ভৈরবের শহর থেকে গ্রামাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় এর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাহারি রং আর নামের দেশি-বিদেশি কবুতর নিয়ে গড়ে ওঠা খামারগুলো সম্পূর্ণ পারিবারিক পরিবেশে অল্প পরিসরে থাকলেও মুনাফা বেশ লোভনীয়। এই খামারগুলোতে বাড়তি কোনো কাজের লোকের প্রয়োজন হয় না। পরিবারের লোকজন সংসারের অন্যান্য কাজের ফাঁকে শ্রম দিয়েই এ খামার পরিচালনা করতে পারেন।

খামারের এসব কবুতর দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি রয়েছে বাহারি সব নাম। কোনোটার নাম বোম্বাই, বুখারি, সিরাজি, কিং, ময়ূরপঙ্খী, শাটিং। কোনোটা আবার হেলমেট, মুখি, লোটন, রেন্ড, মন্টি কিংবা ম্যাকপাই।

কবুতর বছরে দুইবার ডিম দেয়। প্রতিবার দুটি করে ডিম দেয়। ডিম থেকে বাচ্চা ফোটাতে সময় নেয় ২১ দিন বা তিন সপ্তাহ। বাচ্চা ফোটানোর এক মাস পর থেকে বাচ্চা বিক্রি করা যায়। তখন যেই কবুতরের প্রজাতি যত সুন্দর ও বিরল, সেটির মূল্য তত বেশি হয়ে থাকে।

তবে সাধারণত এসব খামারের প্রতিজোড়া কবুতরের বাচ্চা বিক্রি হয় পাঁচ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকায়।

এসব তথ্য জানিয়েছেন গজারিয়া ইউনিয়নের বাঁশগাড়ি গ্রামের টেকপাড়ার কবুতর খামারি মোস্তফা মিয়া, কালিকাপ্রসাদ ইউনিয়নের খাসখাওলা গ্রামের নাছির মিয়া ও মুক্তার হোসেন, ভৈরব পৌর এলাকার কমলপুর গ্রামের মোমেন সরকার, ভৈরবপুর গ্রামের আনোয়ার হোসেন ও চন্ডিবের গ্রামের জাকারিয়া।

তাঁরা আরো জানান, কবুতর খাদ্য হিসেবে খায় গম, ভুট্টা, সরিষা, বার্জা, চীনা, কীট, ইকটি ও পানি। দিনে দুবার এদের খাঁচায় খাবার ও পানি দিতে হয়। এ ছাড়া আর কোনো শ্রমের প্রয়োজন হয় না। তবে কবুতর পালনে রোগ-বালাই একটা বড় সমস্যা বলে জানান তাঁরা। অনেক সময় রোগে আক্রান্ত হয়ে কবুতর মারা যায়।

স্থানীয় প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে সময়মতো পরামর্শ ও চিকিৎসাসেবা পেলে অনেক উপকৃত হবেন বলেও জানান খামারিরা।

অন্যদিকে ভৈরবে কবুতর ছাড়াও দেশি-বিদেশি নানা জাতের ও রঙের পাখি পালনকেও অনেকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। সেসব খামারে এক থেকে দেড় লাখ টাকা পুঁজি খাটিয়ে মাসে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন অনায়াসে। ককাটেল, বাজজিকা, ইংলিশ বাজজিকা, প্রিন্স, মনিহার, বিভিন্ন জাতের লাভবার্ড, রিংনাইট, ডায়মন্ড বার্ড, গোল্ডেন প্রিন্স, বাজিগর, অস্ট্রেলিয়ান ঘুঘু, দেশি টিয়া, ময়না, চন্দনা, কোয়েল ইত্যাদি নানা রকম নাম ও বর্ণের সব পাখি আছে খামারগুলোতে, যাদের কিচিরমিচির শব্দ আর চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে কেউ বিমোহিত হবেন।

ভৈরব পৌর শহরের তাঁতারকান্দি এলাকার পাখি খামারি আবুল কালাম আজাদ, চন্ডিবের রেলওয়ে কলোনির তপু এবং জগন্নাথপুর গ্রামের তৌফিকুল ইসলাম জানান, পাখি খুব কম খাবার খায়। এদের খাবারের মধ্যে আছে কাউন, চীনা, সূর্যমুখীর বিচি, বিভিন্ন জাতের শাক ও পানি। এরা একসঙ্গে ৪ থেকে ১০টি ডিম দেয়। সেই ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর কিছুদিন পরই আবারও ডিম দেয়। তাই খামারে পাখির সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

পাখির রোগ-বালাই হয় না বললেই চলে। রোগের মধ্যে শুধু সিজনাল ঠান্ডায় আক্রান্ত হয় ওরা। তখন খামারে তুলসীপাতা রেখে দিলে নিজেরাই খেয়ে নেয়।

খামারের কবুতর ও পাখি বিক্রিতেও ঝক্কি-ঝামেলা নেই বলে জানান খামারিরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে সহজেই ক্রয়-বিক্রয়ের কাজটি করে নেন তাঁরা। এ ছাড়া স্থানীয়ভাবে তাঁরা একে অন্যের সঙ্গে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন। সেই নেটওয়ার্ক কাজে লাগিয়ে তাঁরা এক খামারের তথ্য অন্য খামারে এবং ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকেন।

কবুতর ও পাখির খামারকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় উল্লেখ করে স্থানীয় প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম জানান, চাকরির পেছনে না ছুটে কবুতর ও পাখি পালন করে বেকার যুবকরা সহজেই স্বাবলম্বী হতে পারেন। রোগাক্রান্ত হওয়ার আগে খামারিরা তাঁদের কাছে এলে তাঁরা ভালো সেবা দিতে পারবেন বলেও জানান। অনেক সময় অপচিকিৎসার শিকার হয়ে খামারিরা তাঁদের কাছে এলে তাঁদের তেমন কিছুই করার থাকে না বলেও জানান এই কর্মকর্তা। এ ক্ষেত্রে তিনি খামারিদের আরো সতর্ক এবং স্থানীয় প্রাণিসম্পদ অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির আহ্বান জানান।