মিথির শেষ কথা ছিল, ‘বাবা, আমাকে বাঁচাও’

Looks like you've blocked notifications!
মা-বাবার সঙ্গে তানজিলা মৌলি মিথি (মধ্যে)। ছবি : সংগৃহীত

রাজধানী বনানীর এফ আর টাওয়ারের ১০তলা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে চারিদিকে কালো ধোঁয়া আর আগুনের লেলিহান শিখা। এর মধ্যেই আটকা পড়েন মিথি। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা তাঁর আর্তচিৎকার শোনার কেউ নেই। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না সদ্য বিবাহিতা এই তরুণী। তাই বাঁচার আকুতি জানাতে ফোন করলেন বহু মাইল দূরে থাকা বাবা-ভাইকে।

কিন্তু তাঁর মতোই অসহায় ছিলেন বাবা-ভাইও। প্রিয় মেয়েকে বাঁচাতে কিছুই করতে পারলেন না বাবা অ্যাডভোকেট মাসুদুর রহমান। মিথির লাশ নিতে এসে বারবার কানে ভেসে উঠছে মেয়ের শেষবারের মতো বলা কথাগুলো, ‘বাবা, আমি আগুনে পুড়ে মরে যাব, আমাকে বাঁচাও।’

গত বৃহস্পতিবার বনানীর এফ আর টাওয়ারের আগুন কেড়ে নিয়েছে তানজিলা মৌলি মিথির প্রাণ। বিয়ের আট মাস না পেরোতেই সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আগুন লাগা ভবনের ১০ তলায় হেরিটেজ এয়ার এক্সপ্রেস নামের একটি কোম্পানিতে সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। গ্রামের বাড়ি বগুড়ার সান্তাহার পৌরসভার বশিপুর সরদারপাড়া এলাকায়।

গত বছর রায়হানুল ইসলাম রায়হানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিলো মিথির। রায়হান কাজ করেন ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসে।

মিথির বড় চাচা সালাউদ্দিন সরদার বলেন, মিথির অফিস ছিল এফ আর টাওয়ারের ১০তলায়। নয়তলায় আগুন লাগার পর উপরের তলার লোকজন আটকা পড়লে ফুপাতো ভাই মৌসুমকে ফোন করে মিথি বলেন, ‘আমি আটকা পড়ে আছি, তোমরা আমাকে সেভ করো।’

এরপর স্বামী রায়হানকে ফোন করলে তিনি উপরের তলায় উঠে আশ্রয় নিতে স্ত্রীকে পরামর্শ দেন। সর্বশেষ মিথি ফোন করেন বাবাকে। বাঁচার আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘বাবা আমি আগুনে পুড়ে মরে যাব, আমাকে বাঁচাও।’

এরপর আর মিথিকে কেউ মোবাইলে পাননি। বিকেলে শরীর ঝলসানো অবস্থায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাঁকে উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে নেওয়ার কিছুক্ষণ পরে মারা যান তিনি। সঙ্গে থাকা পরিচয়পত্র দেখে মরদেহ শনাক্ত করে কর্তৃপক্ষ লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে।

চাচা সালাউদ্দিন সরদার আফসোস করে বলেন, মিথি তার স্বামীকে সংসারে সহায়তা করতেই চাকরি নিয়েছিলেন। অনাগত দাম্পত্য জীবন নিয়ে তার কতই না স্বপ্ন ছিল।

ওদিকে মেয়ের ফোন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা মাসুদুর রহমান বগুড়া থেকে ঢাকার বাস ধরেন। রাত ৯টায় হাসপাতালে পৌঁছে মিথিরা লাশ দেখতে পান তিনি।

মিথির বন্ধু তুলিকা ইমন বলেন, ‘মিথি নিশ্চয়ই জানত না, সুন্দরভাবে শুরু হওয়া সকালটা সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কালো ধোঁয়ায় পরিণত হবে। বাবা তাঁকে শেষবারের মতো নিতে আসবেন ঢাকায়।

তুলিকা জানান, মিথির প্রতিটা পরীক্ষায় তাঁকে নিয়ে কেন্দ্রে যেতেন মাসুদুর রহমান এবং নিয়ে আসতেন। বাসায় ফিরতে একটু দেরি হলে নিজেই এগিয়ে নিয়ে আসতেন মেয়েকে।

‘তাঁর বাবা এবারও তাঁকে নিয়ে যেতে এসেছেন। কিন্তু জীবিত নয়, লাশ।’ আফসোস করে বলেন তুলিকা।

শুক্রবার দুপুরে মিথির লাশ সান্তাহারে পৌঁছালে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। একমাত্র কন্যাকে হারানো পরিবারে বইছে মাতম। প্রতিবেশীরাও নির্বাক।

মিরপুরে রাত ১২টায় প্রথম জানাজা শেষে শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় নিজ গ্রাম বশিপুরে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বাদ জুমা বাবলুর চাতালে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

তানজিলা মৌলি মিথি ২০০৯ সালে সান্তাহার সরকারি হার্ভে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০১১ সালে সান্তাহার সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর এশিয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেন।