মাদ্রাসাছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা, প্রধানমন্ত্রীর উদ্বেগ

Looks like you've blocked notifications!
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের হাইডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে ভর্তি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি। ছবি : এনটিভি

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যত রকম চিকিৎসা লাগে তাঁকে দেওয়ার জন্য চিকিৎসকদের নির্দেশ দিয়েছেন।

সেই সঙ্গে নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় যারা জড়িত তাদের সবাইকে অবিলম্বে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছেন।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন আজ রোববার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এই নির্দেশ দেন।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসার পর ডা. সামন্ত লাল সেন সাংবাদিকদের এসব কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আজ দুপুর ১টার সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে আমি দেখা করতে যাই। প্রধানমন্ত্রী প্রথমেই ফেনীর ছাত্রী নুসরাতের বিষয়ে খোঁজখবর নেন। বিস্তারিত শুনে তিনি মর্মাহত ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। যত রকম চিকিৎসা লাগে ছাত্রীকে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন।’

‘প্রধানমন্ত্রী আমার সামনেই নির্দেশ দিয়েছেন, এই ঘটনায় যারা জড়িত তাদের সবাইকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে’ বলছিলেন সামন্ত লাল সেন।

এনটিভির ফেনী প্রতিনিধি ওছমান হারুন মাহমুদ জানান, এদিকে বোরকাপরা যে চার ছাত্রী নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল তাদের কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। তবে মাদ্রাসার একজন শিক্ষক ও একজন  ছাত্রকে আটক করেছে তারা।

বিষয়টি নিশ্চিত করে সোনাগাজী থানার ভারপ্রাপ্ত কমকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, আগুনে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনায় নুসরাতের পরিবার এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করেনি। এ কারণে তারা বেশি দূর এগুতে পারছেন না।

সেই অধ্যক্ষ বরখাস্ত , মাদ্রাসা বন্ধ

আগুনে দগ্ধ নুসরাত জাহান রাফির শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে করা মামলায় কারাগারে থাকা আসামি সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছেন মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি ও ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পি কে এম এনামুল করিম। তিনি জানান, নুসরাতের চিকিৎসার জন্য মাদ্রাসার তহবিল থেকে দুই লাখ টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, আলিম পরীক্ষার জন্য মাদ্রাসা বন্ধ না রেখে সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত চালু রাখা হয়েছিল। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনার পর শনিবার বিকেলে প্রতিষ্ঠানের নোটিশ বোর্ডে আগামী ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত মাদ্রাসা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে হোস্টেলের ছাত্রদের হল ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। তবে আলিম পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে মাদ্রাসা খোলা থাকবে।  

নুসরাত এবার সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসা থেকে আলিম (এইচএসসি সমমান) পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। তিনি সোনাগাজীর উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের মাওলানা এ কে এম মুসা মানিকের মেয়ে। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মাদ্রাসা ভবনের ছাদে দুর্বৃত্তরা তাঁর গায়ে আগুন দেয়। তাঁকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ফেনী সদর হাসপাতাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে।

পরিবারের অভিযোগ, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ এস এম সিরাজউদ্দৌলা গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহানের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। নুসরাত বিষয়টি বাসায় জানালে তাঁদের মা সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সোনাগাজী থানা পুলিশ অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেপ্তার করে।

এরপর মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাতকে চাপ দেয় সিরাজউদ্দৌলার লোকজন। কিন্তু নুসরাত অপারগতা প্রকাশ করেন। এ অবস্থায় আলিম পরীক্ষা শুরুর দিন থেকে ভাই নোমান নুসরাতকে পরীক্ষার হলে বসিয়ে দিয়ে আসতেন। গতকাল তিনি তাই করেন।

যেভাবে পোড়ানো হয় নুসরাতকে

নুসরাতের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান গণমাধ্যমের কাছে গতকালের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন।

নোমান বলেন, শনিবার ছিল আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা। সকালে বোনকে নিয়ে পরীক্ষার হলে বসিয়ে দেওয়ার জন্য মাদ্রাসায় ঢোকার সময় মাদ্রাসার অফিস সহকারী মোস্তফা তাঁকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেন। নুসরাত পরীক্ষার হলে বসলে সাড়ে ৯টার দিকে অধ্যক্ষের পক্ষের কয়েকজন ছাত্রী নুসরাতকে ডেকে ছাদে নিয়ে যায় এবং মামলা উঠিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। নুসরাত তাতে রাজি না হওয়ায় তাঁর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন নিয়ে নুসরাত নিচে দৌড়ে এলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও পরে ফেনী সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত চিকিৎসক উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠান।

তবে কয়েকজন ছাত্রী দাবি করেন, মাদ্রাসার ছাদে উঠে নিজের শরীরে পেট্রল ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ওই ছাত্রী।

অধ্যক্ষের কক্ষে যা ঘটেছিল

নুসরাতের মাদ্রাসায় দশম শ্রেণিতে পড়ে ছোট ভাই রাশেদুল হাসান রায়হান। দগ্ধ বোনের বরাত দিয়ে সে জানায়, গত ২৭ মার্চ দুপুর পৌনে ১২টার দিকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা তাঁর পিয়ন নুরুল আমিনকে দিয়ে নুসরাতকে অধ্যক্ষের রুমে ডেকে নেন। নুসরাত তখন আরো তিন-চারজন বান্ধবীকে নিয়ে অধ্যক্ষের রুমে ঢুকতে চাইলে শুধু তাঁকে ঢুকতে দেন পিয়ন। এরপর দরজা আটকে অধ্যক্ষ বিভিন্ন প্রলোভন দেখান। ১ এপ্রিল আলিম পরীক্ষার আধা ঘণ্টা আগে তাঁকে প্রশ্ন দেওয়া হবে, যদি তিনি অধ্যক্ষের কুপ্রস্তাবে রাজি হন। এরপর অধ্যক্ষ নুসরাতের শরীরের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর নুসরাত দৌড়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে বাইরে গিয়ে অচেতন হয়ে পড়ে যান।

এরপর মাদ্রাসায় থাকা ছোট ভাই রায়হানকে খবর দেওয়া হলে সে বোনের কাছে যায়। এরপর অধ্যক্ষ তাকে জানান, তার বোন অসুস্থ। অসুস্থ থাকার কারণে অধ্যক্ষের কাছে এসেছিল ছুটির আবেদন করতে। এখানে এসে আবার সে অসুস্থ হয়ে পড়ে।

সেখান থেকে নুসরাতকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। বাসায় নিয়ে যাওয়ার পর কিছুটা সুস্থ হলে স্বজনদের জানান, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিলেন। এরপরে ক্ষুব্ধ হয়ে স্বজনরা মাদ্রাসায় গিয়ে অধ্যক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তবে তিনি ওই অভিযোগ অস্বীকার করেন। এরপর মাদ্রাসা অধ্যক্ষ উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতাকে ফোন দেন। আওয়ামী লীগের নেতা পুলিশসহ মাদ্রাসায় যান। তবে মাদ্রাসায় গিয়ে সব ছাত্রছাত্রীর মাধ্যমে সত্য ঘটনা জানতে পেরে পুলিশ উল্টো অধ্যক্ষকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এরপর নুসরাতের মা বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় পরের দিন তাঁকে আদালত পাঠানো হয়। আদালত তাঁর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান।

রায়হান আরো জানায়, শনিবার সকালে মাদ্রাসায় গেলে এক ছাত্রী তাঁর বোন নুসরাতকে বলে যে তাঁর বান্ধবী নিশাতকে কারা যেন ছাদে মারধর করছে। পরে নুসরাত মাদ্রাসার তৃতীয় তলার ছাদে গেলে সেখানে বোরকাপরা ও হাতে মোজা লাগানো চার ছাত্রী তাঁকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। বলে, মামলা তুলে না নিলে তাঁকে মেরে ফেলা হবে। এরপর নুসরাত মামলা তুলে নেওয়ার কথা প্রত্যাখ্যান করে তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টার বিচার দাবি করেন। পরে ওই চারজন তাঁর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর তারা পালিয়ে যায়।

মেডিকেল বোর্ড গঠন

নুসরাতের চিকিৎসায় আজ রোববার একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক আবুল কাসেম। তিনি বলেন, আজ তাঁর নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এরই মধ্যে মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা দুবার ওই ছাত্রীকে দেখেছেন।

‘মাদ্রাসাছাত্রীর অবস্থা ভালো নয়, আশঙ্কাজনক। তাঁর পা থেকে গলা পর্যন্ত ৭০ শতাংশের বেশি দগ্ধ হয়েছে। তাঁর শ্বাসনালিও পুড়েছে। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের হাইডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে ভর্তি রাখা হয়েছে,’ যোগ করেন আবুল কাসেম।