মুখে নেই ভাষা, হাতে আছে আশা

Looks like you've blocked notifications!
ছবি আঁকায় ব্যস্ত কিশোরগঞ্জের ভৈরবের চিত্রশিল্পী গুলশান আরা সুফিয়া কামাল। ছবি : এনটিভি

মুখে ভাষা নেই। কিন্তু বোধে প্রখর। আর সেই বোধও চিত্রকলার। শিল্পের কঠিনতম একটি শাখায়। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। নেই গুরুর ছায়াও। তারপরও দারুণ আঁকিয়ে। এরই মধ্যে স্থানীয় শিল্পবোদ্ধাসহ ভিনদেশি বহু অতিথির নজরও কেড়েছেন  বিস্ময়কর এই চিত্রশিল্পী। বিদেশিরা ওর চিত্রকর্ম কিনে নিজেদের দেশে নিয়ে গেছেন বেশ কয়েকবার। করেছেন পুরস্কৃতও।

বাকপ্রতিবন্ধী এই চিত্রশিল্পীর নাম গুলশান আরা সুফিয়া কামাল (২২)। কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের জামালপুর সরকার বাড়ির মরহুম আজিজুল হক সরকার ও পারভীন আক্তার যূথীকার বড় সন্তান তিনি। পড়াশুনা করেন ভৈরব পৌর শহরের চণ্ডীবের হাজী আসমত আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণিতে। একই প্রতিষ্ঠানে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে সুফিয়ার ছোট বোন দীপান্বিতা সরকার রাফিয়া, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে আরেক বোন নিশাত তাসনিম লাবিবা।

প্রাকৃতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ছবি আঁকার প্রধান উপজীব্য হলেও, আন্দোলন-সংগ্রাম, জ্ঞানী-গুণী মানুষসহ কোনো কিছুই বাদ নেই-যা সুফিয়ার রংতুলির ক্যানভাসে ফুটে ওঠেনি। রং, তৈল আর পেন্সিলে আঁকা শত শত চিত্রকর্ম তাঁর ভাণ্ডারে। প্রতিদিনই এঁকে চলেছেন, বিরামহীন। সুপ্ত এই প্রতিভা বিকাশে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ চান এই এতিম তরুণী।

মা ও ছোট দুই বোনের সঙ্গে কিশোরগঞ্জের ভৈরবের চিত্রশিল্পী গুলশান আরা সুফিয়া কামাল। পেছনে তাঁর আঁকা ছবি। ছবি : এনটিভি

নাম রেখেছিলেন কবি সুফিয়া কামাল

দেশের প্রখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল গুলশান আরাদের পারিবারিক আত্মীয় ছিলেন। ১৯৯৭ সালের ২৬ জুন যখন তাঁর জন্ম হয়, তখন বার্ধক্যজনিত কারণে কবি শয্যাশায়ী। তাঁর জন্ম সংবাদ জানিয়ে কবির কাছে নাম রাখার বায়না রাখা হয় পরিবারের পক্ষ থেকে। তখন একটি কাগজে কবি নিজের নামটি লিখে দিয়ে বলেন, ‘আমার বিদায় বেলায়, ওর আগমন। তাই আমার নামটিই ওকে দিয়ে গেলাম।’

বাংলা সাহিত্যের এত বড় কবির এমন আশীর্বাদে পরিবারের লোকজন তখন থেকেই স্বপ্ন দেখায় মগ্ন হন। বিশেষ করে বাবা আজিজুল হক সরকার আর মা পারভীন আক্তার যূথীকা নিজেদের কন্যা সন্তানটিকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর হন। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে যে তাদের জন্য এমন বিস্ময় অপেক্ষা করছিল, তাঁরা সেটি ভাবেননি। মেয়ের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বুঝতে পারেন, আর অন্যসব শিশুদের মতো তাঁদের শিশুটি নয়।

মেয়ের দুই বছর বয়স থেকেই তাঁরা ছোটাছুটি শুরু করে দেন চিকিৎসকদের কাছে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা যায়, মেয়ে তাঁদের বাকপ্রতিবন্ধী। মেয়ের এই অবস্থায় তাঁরা চিন্তিত হলেও ভেঙে পড়েননি। পাঁচ বছর বয়স হলে ‘ওয়ার্ল্ড কনসার্ট’ নামের একটি স্থানীয় বিশেষায়িত স্কুলে ভর্তি করান ওকে। সেখানকার শিক্ষকদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সে বাংলা বর্ণমালা বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করে।

কিশোরগঞ্জের ভৈরবের চিত্রশিল্পী গুলশান আরা সুফিয়া কামালের আঁকা ছয়টি ছবি। ছবি : এনটিভি

বাবার মৃত্যুর পর পরিবারে বিপর্যয়

কিন্তু ২০১২ সালের অক্টোবর মাসে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান বাবা আজিজুল হক সরকার। সুফিয়া তখন চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করা আজিজুল হক সরকারের আকস্মিক মৃত্যুতে সুফিয়াসহ আরো দুই কন্যা শিশু নিয়ে মা যূথীকা চরম অভাবের মধ্যে পড়ে যান। বন্ধ হয়ে যায় তিন মেয়ের পড়াশোনা।

২০১৪ সালে স্থানীয় হাজী আসমত আলী বালিকা শিশু পরিবার নামের একটি এতিমখানায় চাকরি নেন যূথীকা। তিন মেয়েরও ঠাঁই হয় সেখানে। পরে সেখানে থেকে স্থানীয় রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পিইসি ও জেএসসি পাস করেন সুফিয়া। বর্তমানে এতিমখানার সহযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হাজী আসমত আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে সুফিয়া ও তাঁর দুই বোন পড়ছে।

দান-অনুদানের উদ্দেশে এই এতিমখানায় বছরের বিভিন্ন সময় মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকার বহু অতিথি আসেন। তাঁরা সুফিয়ার চিত্রকর্ম দেখেন মুগ্ধ হন। এরই মধ্যে কয়েকজন অতিথি সুফিয়ার চিত্রকর্ম সম্মানী দিয়ে নিয়ে গেছেন তাঁদের দেশে। অতিথিরা তাঁকে অর্থের পাশাপাশি ছবি আঁকার বহু উপকরণও উপহার হিসেবে দিয়েছেন।

সুফিয়া মুখে বলতে না পারলেও কাগজে লিখে জানান, তিনি বড় চিত্রশিল্পী হতে সুযোগ চান। একই ইচ্ছা তাঁর মায়েরও। মেয়ের চাহিদা মতো আঁকার বিভিন্ন উপকরণ কিনে দিতে না পারার অক্ষমতায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি জানান, সুফিয়ার বাবা বেঁচে থাকলে তাদের এমন নাজুক অবস্থায় পড়তে হতো না। অন্যের সাহায্যেরও প্রয়োজন হতো না।

কিন্তু আজ সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা ছাড়া তাঁর মেয়ের প্রতিভা বিকাশের কোনো সুযোগ নেই। তিনি মেয়ের উন্নতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ চান। তাঁর বিশ্বাস, তেমন সুযোগ পেলে একদিন জগৎখ্যাত চিত্রশিল্পী হবেন তাঁর মেয়ে।

কিশোরগঞ্জের ভৈরবের চিত্রশিল্পী গুলশান আরা সুফিয়া কামালের আঁকা ছবি কিনে নেন ফরাসি অতিথি এমিলি বসকিট। ছবি : এনটিভি

পারিবারিক সমৃদ্ধ ঐতিহ্য

সুফিয়ার পারিবারিক ঐতিহ্যও বেশ সমৃদ্ধ। ওর বড় চাচা ফজলুল হক সরকার ছিলেন বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। আরেক চাচা নজরুল ইসলাম সরকারও সুরকার, গীতিকার ও শিল্পী। তাঁর কাছে হাতেখড়ি হয়ে দেশের নামকরা শিল্পী হয়েছেন বেশ কয়েকজন। ওর মা খেলাঘর সংগঠনের কর্মী হিসেবে শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। করতেন প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতিও।

সুফিয়ার চাচা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নজরুল ইসলাম সরকার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘প্রকৃতিগতভাবে সুফিয়া শিল্পবোধ নিয়ে জন্ম নিয়েছে, সেটিতে যদি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আঁচড় পড়ে-তবে সে অনেক বড় মাপের চিত্রশিল্পী হবে। দেশের সুনাম কুঁড়িয়ে আনবে।’ তিনি এ ক্ষেত্রে বর্তমান শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক সরকারের সহায়তা কামনা করেন।

এদিকে একই রকম অভিপ্রায় ও প্রত্যাশা সুফিয়ার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক মো. সাইদুর রহমান বাবলুর। তিনি বলেন, কোনো প্রকার শিক্ষা ছাড়া সুফিয়া স্থানীয় ও বিদেশি শিল্পবোদ্ধাদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। যদি তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পায়, তবে তাঁর প্রতিভার সঠিক বিকাশ ঘটবে। এ ক্ষেত্রে তিনি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ দেশের হৃদয়বান ব্যক্তিদের সহায়তা কামনা করেছেন।