নিজ শহরেই ‘ধূসর’ কবি জীবনানন্দ দাশ
ঢাকা থেকে লঞ্চে করে পৌঁছালাম কবি জীবনানন্দ দাশের শহর বরিশালে। কাকডাকা ভোরে লঞ্চঘাটে ভিড়তেই দেখা গেল টার্মিনালে থেমে থাকা আরেকটি লঞ্চের ছাদে রেলিংয়ের ওপর বসে আছে একঝাঁক শালিক। স্নিগ্ধ ভোরে এমন ঝাঁকবাঁধা শালিক দেখলে জীবনানন্দপ্রেমী মাত্রেরই মনে পড়ে যাবে, শঙ্খচিল-শালিকের বেশে কবি ফিরে আসতে চেয়েছিলেন এই বাংলায়।
সাইরেন বাজিয়ে আরো দুটি লঞ্চ এসে ভিড়ল ঘাটে। ভোরের আলো সোনালি আভা ছড়াচ্ছে। জীবনানন্দের স্মৃতির সন্ধানে আসা যে কারো কাছেই প্রথম দর্শনে স্নিগ্ধ পরিবেশ তাঁকে আপ্লুত করবে।
লঞ্চ থেকে নেমে টার্মিনালের বাইরে এসে দাঁড়াতেই চোখে পড়ল সারি সারি রিকশা আর মোটরযান, তারা যাত্রীদের অপেক্ষায় আছে। মধ্যবয়স্ক এক রিকশাচালকের কাছে জানতে চাইলাম, জীবনানন্দ সড়কে যাবে কি না? তিনি বললেন, ওই এলাকা তিনি চেনেন না।
এরপর একে একে আরো বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলেও একই উত্তর। কেউই জীবনানন্দ সড়ক চেনেন না। তরুণ, মধ্যবয়সী কিংবা বয়স্ক চালক-এদের কেউ এ শহরে জীবনানন্দ সড়কের নাম শোনেননি!
বিষয়টি খেয়াল করছিলেন এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। শহরে আগন্তুকের সাহায্যার্থে জানতে চাইলেন- ‘কোথায় যাবেন?’ জীবনানন্দ সড়কের কথা বললে তিনিও চিনতে পারলেন না। আরো একটু নির্দিষ্ট করে জানালাম, জীবনানন্দ দাশের বাড়ি যেখানে ছিল, সেখানে যাব। এ শহরে তাঁর বাড়িটি ঠিক কোথায় ছিল, তাও জানেন না সেই ভদ্রলোক।
মূলত এই সড়কটি বগুড়া রোড নামে পরিচিত। এখানেই ছিল নিসর্গের শুদ্ধতম কবি রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের বাড়ি। কিন্তু অনেকেই তা জানেন না। নিজ শহরেই অবহেলায় ধূসর হয়ে আছেন তিনি।
এখানকার জীবন কিংবা সংস্কৃতিচর্চায় যে জীবনানন্দের তেমন কোনো ছাপ নেই, তা শহরে প্রবেশের মুখেই বোঝা যায়। এ শহরে নেমে খ্যাতিমান এ কবির বাড়িটি কোন দিকে ছিল জানতে চাইলে, বেশির ভাগ মানুষই আপনাকে হতাশ করবে।
বরিশালে যাওয়ার পথে লঞ্চঘাটেই দীর্ঘক্ষণ কথা হয় রিকশাচালক মোহাম্মদ আলমের সঙ্গে। আলম জানান, এ শহরে তাঁর জন্ম, আর রিকশা চালান ২০ বছরের বেশি সময় ধরে। কোনোদিনও নাকি ওই সড়কের (জীবনানন্দ দাশ সড়ক) নাম শোনেননি তিনি! আমার কাছেই নাকি এ সড়কের নাম প্রথম শুনলেন।
শহরের বগুড়া রোড হিসেবে পরিচিত সড়কটির নামই ‘জীবনানন্দ সড়ক’ জানালে আলম লজ্জার হাসি দিয়ে বলেন, ‘আমারে তো কেউ কোনোদিন এই কথা কয় নাই।’
আলম মিয়ার রিকশায় চেপেই গেলাম জীবনানন্দ সড়কে অবস্থিত তাঁর বাড়ি প্রাঙ্গণে। যদিও কবি পরিবার এই বাড়ি ভিটেমাটি ত্যাগ করেছেন বহু আগেই। তবে তার জন্ম, শৈশব, কৈশোর তারুণ্য, বেড়ে ওঠা তো এই প্রাঙ্গণের ধুলোমাটি, আলো-বাতাস দিয়েই। আর তাই এ শহরে বেড়াতে গেলে জীবনানন্দপ্রেমীরা খুঁজে বেড়ান তাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো।
কিন্তু একেবারে অচেনা একজন আগন্তুকের জন্য এই শহরে এসে জীবনানন্দের স্মৃতিময় স্থান খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। কেননা এই শহরে কবির স্মৃতি ধারণ করে আছে এমন কিছু নেই।
শহরের প্রাণকেন্দ্রে যে বাড়িটিতে কবি থাকতেন, সেটির নাম এখন ‘ধানসিঁড়ি’। সেখানে নেই কবির কোনো স্মৃতিচিহ্ন। বাড়িটির মালিক এখন অন্য একটি পরিবার। ওই বাড়ির পাশে সম্প্রতি কবির নামে একটি পাঠাগার নির্মিত হয়েছে। সেটিও প্রাণহীন। এমনকি এই পাঠাগারে কবির সব বইও খুঁজে পাওয়া যাবে না!
জীবনানন্দ দাশের বাড়িটি যে এলাকায় ছিল, তার পাশেই এ অঞ্চলের অন্যতম বিদ্যাপীঠ ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ। আরেক দিকে রয়েছে ব্রজমোহন (বিএম) স্কুল। ১৯০৮ সালে এই বিএম স্কুলেই তিনি পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। এই স্কুলেও নেই তাঁর কোনো স্মৃতিফলক।
স্কুল শেষে তিনি ভর্তি হন বিএম কলেজে। পরবর্তীকালে এ কলেজের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন অনেক বছর। তাঁর অধ্যাপনা জীবনের বেশির ভাগ সময় তিনি দিয়েছেন বিএম কলেজে। কিন্তু এখানেও কবি তেমন সমাদর পাননি উত্তরসূরিদের কাছে। উচ্চশিক্ষার এই বিদ্যাপীঠটিও অগ্রসর ভূমিকা পালন করতে পারেনি তাঁর যথাযথ মূল্যায়ন করতে। এমনকি এ কলেজের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ বন্ধনের যে ইতিহাস, তাও শিক্ষার্থীদের মাঝে তুলে ধরার তেমন কোনো কার্যক্রম নেই।
শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কর্তৃপক্ষ বরাবরই এ বিষয়ে উদাসীন। কবির স্মৃতি ভাস্কর্য নির্মাণের দাবিতে শিক্ষার্থীরা ২০০৯ সালে আন্দোলন গড়ে তুললেও সে দাবি মেনে নেওয়া হয়নি।
কথা হয় আন্দোলনের সংগঠক জাহিদ আবদুল্লাহ রাহাতের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি এত বছরেও। তাই কবির ভাস্কর্যের দাবিতে আন্দোলন করেছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে দাবি না মানার মাধ্যমে।’
আরেক সংগঠক রাজীব আমজাদ বলেন, ‘জীবনানন্দ দাশ এ কলেজের শিক্ষক থাকাকালে যে ভবনটিতে বসতেন, তার সামনের চত্বরটিকে কবি জীবনানন্দ দাশ চত্বর হিসেবে ঘোষণা করি আমরা। কলেজ কর্তৃপক্ষও তাতে সায় দেয়। কিন্তু প্রথমে কলেজ ম্যাপে আনুষ্ঠানিকভাবে চত্বরটির নাম জীবনানন্দ চত্বর হিসেবে ঘোষণার কথা বলা হলেও সেটি এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। পরে আমরা শিক্ষার্থীরাই সেখানে একটি ফলক লাগিয়ে দিই।’
কলেজে গিয়ে দেখা গেল জীবনানন্দ চত্বরের নামফলকটিও হাওয়া হয়ে গেছে। এ বিষয়ে চত্বরেই কয়েক শিক্ষার্থীর সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁরা জানান, কয়েক মাস হলো নামফলকটি আর দেখা যাচ্ছে না। কী হয়েছে তা কেউ বলতেও পারে না।
কলেজে কবির স্মৃতি বলতে রয়েছে কবি জীবনানন্দ দাশ ছাত্রাবাস। শুধু ছাত্রাবাসটির প্রবেশদ্বারেই কবির নাম লেখা। আদতে এটি সব মহলে ‘হিন্দু হল’ নামে পরিচিত! জীবনানন্দ হল নামে সাধারণত কেউ এটিকে ডাকে না।
আক্ষেপ করে কলেজেরই সাবেক শিক্ষার্থী তরুণ কবি মিছিল খন্দকার বলেন, ‘দুঃখের বিষয় হলো এই শহরে তাঁকে যেভাবে মূল্যায়ন করার কথা ছিল, তা করতে পারেনি। একইভাবে বিএম কলেজ কর্তৃপক্ষও যেনতেন ভূমিকা পালন করেছে। তাঁর স্মৃতিকে যেভাবে ধারণ করার কথা ছিল তা আমরা পারিনি। কবিকে (জীবনানন্দ) নানাভাবে শুধু অবহেলাই করা হয়েছে।’
নব্বই দশকের দিকে বরিশাল থেকে প্রকাশিত ‘জীবনানন্দ’ নামে একটি নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে দুই বাংলায় (বাংলাদেশ ও কলকাতা) নিয়মিত জীবনানন্দ চর্চার একটি প্রচেষ্টা শুরু করেন কবি হেনরি স্বপন। কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আসলে কবিকে ধারণ করা, বোঝা ও চর্চার যে মানসিকতা থাকা দরকার, সেটি এখানকার মানুষের নেই। যারা অগ্রসর-শিক্ষিত শ্রেণি তাদের ভেতর থেকেও এ বিষয়ে কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। এমনকি যে কলেজে তিনি পড়াশোনা করেছেন, অধ্যাপনা করেছেন সেখানেও তাঁকে চর্চা করা হচ্ছে না। তাঁর সম্পর্কে জানেন না অনেকেই। এখন পর্যন্ত একটি ইনস্টিটিউট গড়ে ওঠেনি তাঁর শহরে। অথচ এটা খুব জরুরি ছিল যে কবির নিজ শহরে তাঁকে নিয়ে একটি ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা। এটা অন্যান্য জায়গায় হয়েছে অন্যদের নিয়ে। কেবল এ বিষয়েই রহস্যময় উদাসীনতা।’
বরিশালের সাহিত্যপ্রেমী ও তরুণ কবিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কবির জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীতেও তেমন কোনো আয়োজন হয় না। কোনো ধরনের ঘরোয়া আলোচনা সভার আয়োজন না করার দৃষ্টান্তও আছে। অল্প অল্প করে অবহেলার ধুলোর আস্তরণ জমতে জমতে এখানে এভাবেই মলিন এক ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ হয়ে উঠেছেন স্বয়ং কবি জীবনানন্দ দাশ।
তবে প্রকৃতির কবিকে প্রকৃতির মাঝেই খুঁজে পাবেন সেখানে গেলে। এখনো খয়েরি ডানার শালিকের ঝাঁক উড়ে বেড়ায়, শিশিরভেজা চালতা ফুল ফোটে, জলাধারের পাশে দেখতে পাবেন ‘ম্লান চোখের’ মতো বেতফল। ‘কলমির গন্ধভরা জল’ এখনো ঢেউ খেলে যায়, কাঁঠালগাছের ছায়ায় দোয়েলের দেখা পাবেন। বিশুদ্ধ বাতাসে শ্বাস নিয়ে সুবজ ঘাসের ওপর শুয়ে দেখে নিতে পারেন অনন্ত নক্ষত্রবিথী। এরপরও এই অঘ্রাণের নবান্নের দেশে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন কবি শঙ্খচিল-শালিক-ধবল বক কিংবা ভোরের কাক হয়ে। মানুষের ভিড় থেকে সরে গিয়ে প্রকৃতির মাঝে মিশে যেতে চাওয়া এই কবি লিখে গেছেন- ‘আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভীড়ে…’ ।
তাই প্রকৃতির কবিকে এখনো সন্ধান করে নিতে হবে এই প্রকৃতির মাঝেই। এ শহর আপনাকে মনে করিয়ে দিতে ব্যর্থ হবে এখানেই কবির বাড়ি, ধুলো-ছায়ার শৈশব, জন্মের আঁতুড় ঘর। এ শহরের পথে হেঁটে হেঁটেই কবি আবিষ্কার করেছেন- রাঙা মেঘ, জোনাকির আলো, হিজলের বন, অদ্ভুদ আঁধার, লক্ষ্মী পেঁচা, ভেজা মেঘের দুপুরে উড়ে বেড়ানো সোনালি ডানার চিল।
এ শহরে গিয়ে আপনি দিব্যচোখে কবিকে খুঁজে পাবেন না, খুঁজে নিতে হবে তাঁকে। এ শহর অবহেলায় ধূসর হলেও প্রকৃতিতে সজীবই আছেন প্রাণে স্পন্দনজাগানিয়া কবি জীবনানন্দ দাশ। আজ কবির মৃত্যুদিনে, কবির প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।