চুরির অভিযোগে দুই শিশুকে ‘শিকলে বেঁধে নির্যাতন’

Looks like you've blocked notifications!
গত রোববার ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায় নির্যাতনের শিকার দুই শিশু সজীব ও জয়। ছবি : এনটিভি

ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায় কবুতর চুরির অভিযোগে দুই শিশুকে গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের মধ্যে এক শিশুর মাথার চুল কেটে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এলাকাবাসী জানায়, ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে কয়েকজন যুবক এই নির্যাতন চালিয়েছে। শিশু দুটিকে নির্যাতন ও চুল কাটার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ ওঠে।

গত রোববার বিকেলে উপজেলার সিদ্ধকাঠি ইউনিয়নের চৌদ্দবুড়িয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

নির্যাতনের শিকার দুই শিশু হলো বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার তবিরকাঠি গ্রামের আশরাফ আলীর ছেলে সজীব (১৫) ও একই গ্রামের আবদুল কুদ্দুসের ছেলে জয় (১৪)। তারা দুজনই স্থানীয় জেড এ ভুট্টো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র।

এলাকাবাসী জানায়, চৌদ্দবুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা পুলিশ কনস্টেবল মো. শাহ আলমের বাড়িতে গত শনিবার রাতে কবুতর চুরি হয়। ওই দিন রাতেই স্থানীয় কয়েকজন যুবক সজীব ও জয় নামের দুই শিশুকে আটক করে। পরে শনিবার দিবাগত রাত ২টা থেকে তাদের ১৫ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। এরপর সিদ্ধকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও ইউনিয়ন যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলামের কাছে ওই দুই শিশুকে নিয়ে যায় স্থানীয়রা। ইউপি সদস্য শিশুদের নিয়ে বিচারে বসেন। এ সময় সজীব ও জয়কে একটি গাছের সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ করে এলাকাবাসী। তাদের কাছ থেকে কবুতর চুরির স্বীকারোক্তি নেন ইউপি সদস্য রফিকুল। নির্যাতনের একপর্যায়ে দুই শিশু কবুতর চুরির ঘটনা স্বীকার করলে তাদের মাথার চুল কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রফিকুল। এক ব্যক্তি ব্লেড দিয়ে জয়ের মাথার মাঝখান থেকে চুল কেটে দেয়। তাদের ২০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়। এ সময় সেখানে স্থানীয় লোকজন উপস্থিত ছিলেন। পরে চুল কাটা ও গাছের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতনের ভিডিও ও ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

এ ঘটনায় জয়ের বাবা বাদী হয়ে গতকাল সোমবার রাতে নলছিটি থানায় ইউপি সদস্য রফিকুল ইসলাম ও পুলিশ কনস্টেবল শাহ আলমসহ আটজনকে আসামি করে মামলা করেন। পরে রাতেই রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি জানান, চৌদ্দবুড়িয়া গ্রামের খালের অপর পারে বাকেরগঞ্জ উপজেলার তবিরকাঠি গ্রাম। ওই গ্রামের দুই শিশু সজীব ও জয় বাখরকাঠি গ্রামের একটি ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করে। কবুতর চুরির অভিযোগে তাদের আটক করে পরিবারের কাছে তুলে না দিয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে বিচার করেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য।

নির্যাতনের শিকার জয় বলে, ‘আমাদের (শনিবার) রাত থেকে পরের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আটকে রাখা হয়। কোনো কিছু খেতে দেওয়া হয়নি। দফায় দফায় মারধর করা হয়। যারা মেরেছে, আমরা তাদের চিনি না। বিকেলে সালিশ ও মীমাংসার কথা বলে গাছের সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে মারা হয়। চুল কেটে দেয়। আমার বাবা এসে আমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।’

জয়ের বাবা আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘আমার ছেলের নামে কবুতর চুরির অপবাদ দিয়ে তাকে মারধর করে চুল কেটে দিয়েছে। আমি এ ঘটনার বিচার চাই। জরিমানার টাকা দুদিনের মধ্যে পরিশোধ করতে বলা হয়েছে। আমি টাকা দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে এনেছি। আমার ছেলের ছবি ফেসবুকে দিয়েছে। অনেকে ফোন করে আমার কাছে ঘটনা জানতে চায়। আমি বিষয়টি নিয়ে লজ্জায় পড়েছি। আমরা গরিব বলে কি আমাদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করা হবে, এর কোনো বিচার হবে না?’

ঝালকাঠির শিশু সংগঠক কাজী খলিলুর রহমান বলেন, ‘শিশুদের গাছের সঙ্গে বেঁধে মারধর এবং চুল কেটে দেওয়ার একটি ভিডিও দেখেছি। এটা অমানবিক। যারাই করেছে, তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা প্রয়োজন, যাতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে।’

সিদ্ধকাঠি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও যুবলীগ নেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছেলে দুটি আমাদের গ্রামে এসে কবুতর চুরি করেছে। আগেও কয়েকজনের বাসা থেকে কবুতর নিয়ে গেছে। সবকিছু তারা নিজেরাই স্বীকার করেছে। আমি তাদের আটকও করিনি, মারধরও করিনি, চুলও কাটিনি। স্থানীয় লোকজন এ কাজগুলো করেছে। এটা ভালো হয়েছে না খারাপ হয়েছে, সেটা তারাই ভালো জানে। আমি কোনো বিচারের ব্যবস্থাও করিনি।’

সিদ্ধকাঠি ইউপি চেয়ারম্যান কাজী জেসমিন ওবায়েদ বলেন, ‘আমার একমাত্র মেয়ের আকদ অনুষ্ঠান ছিল বরিশালে, আমি সেখানে ব্যস্ত ছিলাম। তবে বিষয়টি অল্প অল্প শুনেছি। মেম্বারও আমাকে কিছু বলেননি। আমি সরেজমিনে গিয়ে বিষয়টি দেখব।’

নলছিটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সাখাওয়াত হোসেন জানান, নির্যাতনকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।