৬১ টাকার গ্যাস ৯ টাকায় দিচ্ছি : প্রধানমন্ত্রী

Looks like you've blocked notifications!
সাম্প্রতিক চীন সফর নিয়ে সোমবার গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি : বাসস

সরকার উচ্চমূল্যে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গ্যাসের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি জনগণকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, প্রতি ঘন মিটার এলএনজি আমদানিতে ৬১.১২ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু ব্যাপক ভর্তুকি দিয়ে তা প্রতি ঘন মিটার মাত্র ৯.৮ টাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির পরও ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এরপরও আন্দোলন? তাহলে যে দামে ক্রয় করছি, সেই দামেই বিক্রি করি।

আজ সোমবার বিকেলে সদ্যসমাপ্ত চীন সফর নিয়ে সরকারি বাসভবন গণভবনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সব থেকে বড় প্রশ্ন হলো আমাদের দেশে গ্যাসের প্রয়োজন আছে কি না? দেশে যদি আমরা উন্নতি করতে চাই সেখানে এনার্জি একটা বিষয়। বাংলাদেশে ২০০৮ সাল পর্যন্ত জিডিপি কতটুকু বেড়েছে। আর এখন জিডিপি ৮ দশমিক ১ ভাগ পর্যন্ত অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। এর কারণ আমরা এনার্জির ক্ষেত্রে মনোযোগ দিয়েছি। আমরা নিজেরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করছি। গ্যাস এ মুহূর্তে আমদানি করতে হচ্ছে। এলএনজির আমদানির জন্য খরচ যথেষ্ট বেশি পড়ে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেখানে দাম যেটুকু বাড়ানো হয়েছে তা না বাড়ালে আমাদের কাছে দুটি পথ আছে। হয়, আমাদের জিডিপি যাতে না বাড়ে সে জন্য এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দিয়ে অর্থনীতির উন্নতি সংকুচিত করে নিতে হবে। তখন অর্থনীতির উন্নতি হবে না। আর যদি সত্যিকারের অর্থনীতির উন্নতি চান তাহলে এটা তো মেনে নিতেই হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা শুধু আমাদের দেশে না, বিদেশেও যখন এলএনজি আমদানি করা হয় তখন দাম বৃদ্ধি করে। তখন তারা মেনেও নেয়। আমাদের হয়তো এত বড় সমস্যায় পড়তে হতো না। আপনাদের মনে আছে ২০০০ সালে আমার কাছে প্রস্তাব এসেছিল, আমাদের দেশের গ্যাস বিক্রি করার। কিন্তু আমি রাজি হইনি। সেটার খেসারত দিতে হয়েছিল। আমি ভোট বেশি পেয়েও ক্ষমতায় আসতে পারিনি। আর খালেদা জিয়া মুচলেকা দিয়েছিল ক্ষমতায় আসলে গ্যাস বিক্রি করবে। আমরা কেন গ্যাস বিক্রি করব? আমাদের নিজেদের প্রয়োজনীয় গ্যাস আমরা ব্যবহার করব। আমরা রিজার্ভ রাখব। তারপর যদি থাকে বিক্রির চিন্তা করব। আগে কত গ্যাস আছে তা আমাকে জানতে হবে। আমি সে সময় যে ভবিষ্যৎবাণী করেছি সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।

শেখ হাসিনা বলেন, আজকে আমাকে শিল্পায়ন করতে হবে; বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হবে, সার উৎপাদন করতে হবে, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হবে, অর্থনীতির উন্নতি করতে হবে। আমাকে এলএনজি আমদানি করতে হয়। এটা আমাদানি করতে আমার কত টাকা খরচ হয়, সে হিসাবটা আগে জানতে হবে। আমাদের প্রতি ঘনমিটার এলএনজি আমদানিতে খরচ পড়ে ৬১.১২ টাকা। আর আমরা দিচ্ছি ৯.৮ টাকায়। তাহলে আমরা কী পরিমাণ ভর্তুকি দিচ্ছি।

ভারতের উদাহরণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি দেখেছি অনেকে অন্দোলন করছে। বলছে, ভারতে গ্যাস কম দামে দিচ্ছে। কিন্তু ভারত কত টাকায় দিচ্ছে? ভারতে গৃহস্থালীর জন্য স্থান ভেদে ৩০ থেকে ৩৭ টাকা প্রতি ঘন মিটার গ্যাস। অথচ বাংলাদেশ দিচ্ছে প্রতি ঘন মিটার মাত্র ১২.৬০ টাকায়। শিল্পে বাংলাদেশ দিচ্ছে ১০.৭০ প্রতি ঘনমিটার। আর ভারত দিচ্ছে ৪০ থেকে ৪২ টাকায়। সিএনজি বাংলাদেশ দিচ্ছে ৪৩ টাকা আর ভারত দিচ্ছে ৪৪ টাকায়। বাণিজ্যিকে আমরা দিচ্ছি ২৩ টাকায় আর ভারত এ ক্ষেত্রে দিচ্ছে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায়। আন্দোলনের সময় তারা বলছে ভারত কমিয়েছে।  অথচ ভারত প্রতি বছর দুই বার গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে। এটা তাদের নীতি। আর তারা সেই নীতিতে চলে। বছরের ১ এপ্রিল এবং অক্টোবর মাসে তারা গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে। অর্থাৎ তারা গ্যাসের মূল্যকে সমন্বয় করে। আমরা এলএনজি  ৬১.১২ টাকায় কিনে সেটা দিচ্ছি মাত্র ৯.৮০ টাকায়। আপনারা বিবেচনা করে দেখেন ৬১ টাকায় কিনে দিচ্ছি মাত্র ৯ টাকায়। এরপরও আন্দোলন এবং এই আন্দোলনে মজার ব্যাপার আছে। বাম আর ডান মিলে গেছে এক সুরে। এই তো খুব ভালো। আমার কথা হচ্ছে আগামীতে আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ ভাগ করব। সেখান থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে আমরা ডাবল ডিজিটে নিয়ে যাব। কারণ আমাদের এনার্জি লাগবে। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ লাগবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন লোডশেডিং নেই। সবাই খুব আরামে আছে বলে ভুলে গেছে অতীতের কথা। মাত্র আট-নয় বছর আগে বিদ্যুতের কী অবস্থা ছিল? আপনার জানেন যে, ২০০৪-৫ সালে মিয়ানমারের যে গ্যাস সেখানে ভারত, জাপান, চীন বিনোয়াগ করেছিল। ভারত ওই গ্যাস নিতে চেয়েছিল বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পাইপ লাইন করে। একটা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি সরকার পাইপ লাইনে ওই গ্যাসটা নিতে দেয়নি। সেখানে যদি আমি থাকতাম আমি কী করতাম। আমি গ্যাস তো নিতে দিতামই, আমার ভাগটা রেখে দিতাম। আমাকে দিয়ে তারপর নিতে হবে। আমি কিন্তু পাইপ লাইনে গ্যাস আনতে পারতাম। তাহলে আমার অর্থনীতির কাজে লাগাতে পারতাম। সেই গ্যাস যদি আমদানি করতে পারতাম তাহলে এখন এলএনজি আমদানি না করলেও চলত। তাদের প্রচুর গ্যাস রিভার্ভ আছে। সেটা নিতে পারেনি। চীন কিন্তু কিনে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ আর কারো নেওয়ার উপায় নেই। দেশের কতগুলো সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব যদি ভুল করে তাহলে সেটার খেসারত জনগণকে দিতে হয়। আমি এটুকু বলতে চাই, ৬১.১২ টাকা এলএনজি কিনে মাত্র ৯.৮০ টাকা বিক্রি করছি। এখন যে দাম বৃদ্ধি করছি, তারপরও বছরে এ খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তাহলে আন্দোলন যখন হচ্ছে তখন একটা কাজ করি; যেই দামে ক্রয় করি সেই দামে বিক্রি করব। ৯ টাকার গ্যাস ৬১ টাকা করে নিই। তার ওপর গ্যাসের বিষয়ে ট্যাক্স ভ্যাট ফ্রি করে দিয়েছি। এরপরও যদি আন্দোলন করে মাঝেমধ্যে হরতাল আন্দোলন পরিবেশের জন্য ভালো।

চীন সফরের ফলাফল নিয়ে আজ সোমবার বিকেল ৪টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়। চলে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। সংবাদ সম্মেলনে চীন সফর নিয়ে লিখিত বক্তব্য পড়েন প্রধানমন্ত্রী। এরপর বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাব দেন তিনি।

পাঁচ দিনের সফরে গত ১ জুলাই চীনে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াংসহ দেশটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন তিনি। রোহিঙ্গারা যাতে শিগগিরই তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারে, সে জন্য এ সংকটের দ্রুত সমাধানের বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছে চীন।

ক্ষমতাসীন চীনের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিসি) জানিয়েছে, আপসে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান এবং যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য তারা মিয়ানমারের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।

প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে ঢাকা ও বেইজিংয়ের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা-সংক্রান্ত নয়টি চুক্তি স্বাক্ষর হয়।

চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে—রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তার জন্য এলওসি (লেটার অব এক্সচেঞ্জ) এবং অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতা, বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ, সংস্কৃতি এবং পর্যটন-সংক্রান্ত চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক । এ ছাড়া চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের সঙ্গে দুটি ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ।

চীন সফরকালে প্রধানমন্ত্রী ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বার্ষিক সম্মেলন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের আয়োজনে নাগরিক সংবর্ধনা এবং চীনা ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নেন। এ ছাড়া শেখ হাসিনা তিয়েনআনমেন স্কয়ারে হিরোস মেমোরিয়ালে চীনা বিপ্লবের বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।