শেষবারের মতো সংসদে এরশাদ, দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত

Looks like you've blocked notifications!
জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের দ্বিতীয় জানাজা আজ সোমবার সকালে সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার টানেলে অনুষ্ঠিত হয়। ছবি : ফোকাস বাংলা

জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের দ্বিতীয় জানাজা আজ সোমবার সকালে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার টানেলে এই জানাজায় রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ছাড়াও জাতীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক নেতারা অংশ নেন।

এরশাদের জানাজায় অংশ নিতে সকাল থেকেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে শত শত মানুষ জাতীয় সংসদ ভবনে আসতে থাকেন। এ জন্য কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সারিবদ্ধভাবে তল্লাশির ভেতর দিয়ে সবাইকে ভেতরে প্রবেশ করতে হয়েছে। সারা দেশ থেকেই নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ এইচ এম এরশাদকে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায়।

সকাল ১০টার দিকে সাবেক রাষ্ট্রপতির মরদেহ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) হিমঘর থেকে জাতীয় সংসদ ভবনে নিয়ে আসা হয়। এরশাদের লাশ দক্ষিণ প্লাজার টানেলে রাখার পর সেখানে তৈরি হয় আবেগঘন পরিবেশ। সেখানে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ তাঁর ভালো কাজের সুনাম করছিলেন, কেউ অঝোরে কাঁদছিলেন।

সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে জানাজা পড়ানো শুরু করেন ইমাম। তবে পেছন থেকে ইমামের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছিল না বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন জানাজায় অংশ নেওয়া মানুষ। জানাজায় ইমামতি করেন সংসদ সচিবালয় মসজিদের ইমাম আবু রায়হান। জানাজা শেষে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এরশাদের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরশাদকে শেষবারের মতো দেখতে জানাজায় আসা নেতাকর্মীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন।

জানাজা শেষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মরহুমের মরদেহে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সংসদনেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এ ছাড়া স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে সংসদের সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। সংসদের ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী নিজে গিয়ে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান। সে সময় শত শত নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ সাবেক রাষ্ট্রপতিকে শ্রদ্ধা জানান।

যশোর থেকে এরশাদের জানাজায় আসেন আবদুল আওয়াল (৬৫)। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান সাহেব মেলা (অনেক) ভালো লোক ছিলেন। গ্রাম থেকে শুরু করে স্যার অনেক কাজ করেছেন।’

পাশে ছিলেন জাতীয় পার্টির আরেক কর্মী হামিদ রহমান। তিনি বলেন, ‘সবাই বলে এরশাদ স্বৈরশাসক। আমি বলি, তাহলে বাংলাদেশের জন্য আর একজন স্বৈরশাসক দরকার। তখন যদি বাংলাদেশ আবার গ্রামীণ হয়ে ওঠে।’

এরশাদের মৃত্যুর খবর শুনে টাঙ্গাইল থেকে ছুটে আসেন অটোরিকশাচালক ফিরোজ মিয়া (৩৫)। দক্ষিণ প্লাজার টানেলে দাঁড়িয়ে তিনি কাঁদছিলেন। ফিরোজের পাশে অনেকে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন তাঁর কথা। সে সময় তিনি বলতে থাকেন, ‘এ দেশের যত উন্নয়ন তার বেশির ভাগই এরশাদ করেছেন। তাঁকে আমি অনেক পছন্দ করি। শেষ সময়ে যদি একবার দেখতে পাই, সে জন্য এসেছি।’

জানাজার আগে জাতীয় পার্টির মহাসচিব ও বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা এরশাদের জীবনী পাঠ করেন। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ মরহুমের কর্মময় জীবনের কথা তুলে ধরেন। পরিবারের পক্ষে রওশন এরশাদ বক্তব্য দেন।

জানাজা শেষে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘স্বৈরাচার আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করলেও শেষ জীবনে তিনি গণতন্ত্রের রাজনীতি করেছেন।’ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘মানুষ মরে যাওয়ার পর আমরা তাঁর ভালো দিকটাই বলি, ভুলত্রুটি সব মানুষেরই আছে।’

এরপর এরশাদকে রাজধানীর কাকরাইলে দলের প্রধান কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। লাশ নিয়ে যাওয়ার পর পরই কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর ছেলে এরিক এরশাদ। তখন পরিবারের লোকজন তাঁকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে যান। সেখানে নেতাকর্মীরা সাবেক এই রাষ্ট্রপতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। বাদ আসর তাঁর আরেকটি জানাজা হয় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে। জানাজা শেষে তাঁর মরদেহ ফের সিএমএইচের হিমঘরে রাখা হবে।

গতকাল রোববার সকালে ঢাকা সিএমএইচে মারা যান এইচ এম এরশাদ। গতকালই বাদ জোহর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট কেন্দ্রীয় মসজিদে তাঁর প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তাঁর মরদেহ সিএমএইচের হিমঘরে রাখা হয়।

বিগত শতাব্দীর আশির দশকে সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে টানা আট বছর রাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন এরশাদ। নব্বইয়ের দশকের শেষে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিদায় নেন এই সামরিক শাসক। বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি নানা রোগে ভুগছিলেন।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মারা যাওয়ার পর পরই দলের মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা দলের পক্ষ থেকে সিএমএইচে গণমাধ্যমের কাছে এরশাদের ব্যাপারে পরবর্তী কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরেন। এ সময় সেখানে জাতীয় পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

রংপুর নেওয়া হবে মঙ্গলবার

বৃষ্টি ও খারাপ আবহাওয়ার কারণে আজ এরশাদের মরদেহ রংপুর নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি বলেন, মঙ্গলবার হেলিকপ্টারে করে এরশাদের মরদেহ রংপুর নিয়ে যাওয়া হবে। বাদ জোহর রংপুর জেলা স্কুলের মাঠে এরশাদের শেষ জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। তবে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানাজার স্থান পরিবর্তন হতে পারে বলেও জানান মহাসচিব।

মঙ্গলবারই এরশাদের মরদেহ ঢাকায় ফিরিয়ে এনে সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় কবরস্থানে দাফন করা হবে বলে জানান মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি আরো জানান, পরের দিন অর্থাৎ বুধবার রাজধানীর গুলশানের আজাদ মসজিদে এরশাদের কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে।

বর্ণময় জীবন

বর্ণময় চরিত্রের জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রংপুর জেলার দিনহাটায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। তিনি চট্টগ্রামের পূর্ব বাংলার রেজিমেন্টাল ডিপোর উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৬৬ সালে কোয়েটায় মর্যাদাপূর্ণ কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ থেকে উন্নত কোর্স সম্পন্ন করেন। শিয়ালকোটে একটি ব্রিগেডের সঙ্গে সেবা করার পর তাঁকে ১৯৬৯ সালে তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ড এবং ১৯৭১ সালে সপ্তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ড দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে এরশাদ পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন করেন। পরে তাঁকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল পদে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৭৯ সালে তাঁকে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় ছিলেন। স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের ফলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৯১ সালে এরশাদ গ্রেপ্তার হন। ছয় বছর কারাভোগের পর ১৯৯৭ সালের ৯ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্ত হন।

কারাগারে থেকে এরশাদ ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে নিজ জেলা রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এরশাদ সংসদে পাঁচটি আসনে বিজয়ী হন।

গণঅভ্যুত্থানে পতনের পরও এরশাদের দল জাতীয় পার্টি জাতীয় সংসদে উল্লেখযোগ্য আসনে বিজয়ী হয়। কমবেশি করে একই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল পরবর্তী সময়ের সাধারণ নির্বাচনেও। ২০০৬ সালে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে মহাজোট গঠন করে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের দল ২৭টি আসনে বিজয়ী হয়। এরপর দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এরশাদের দল বিরোধী দলের ভূমিকায় উঠে আসে।