জাহালমের শুনানিতে হাইকোর্ট

দুদক এখন পারে না কেন?

Looks like you've blocked notifications!

বিনা দোষে জাহালমকে প্রায় তিন বছর জেল খাটানোর ঘটনায় মামলার শুনানির একপর্যায়ে হাইকোর্ট বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) শুধু দুর্নাম নয়, আদালত চায় দুদক সুগন্ধি ছড়াক।

ঋণ জালিয়াতির ২৬ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিনা দোষে জাহালমকে প্রায় তিন বছর জেল খাটানোর ঘটনায় আজ মঙ্গলবার দুপুরে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান। দুদক এ সময় পুরো ঘটনার দায় স্বীকার করে নেয়।

শুনানির শুরুতে আইনজীবী খুরশিদ আলম খান আদালতে ২৪ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদন পড়তে শুরু করেন। তিনি আদালতকে বলেন, দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা জাহালমকে সরল বিশ্বাসে আবু সালেক হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এর পেছনে ব্যাংকের কর্মকর্তারা দায়ী ছিলেন। তারা তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুল পথে পরিচালিত করেছিলেন। তখন আদালত বলেন, দিন শেষে তো  দুদকের কর্মকর্তারাই আদালতে রিপোর্ট দেবেন। তাহলে তদন্ত কর্মকর্তা কি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না?

জবাবে খুরশিদ আলম খান বলেন, তদন্ত কর্মকর্তাদের গাফলতি ছিল এতে সন্দেহ নেই। তবে তখন তদন্ত কর্মকর্তাদের অনেকেই নতুন যোগদান করেছিলেন, তাদের অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। এ সময় আদালত বলেন, আপনারা ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির টাকা কী উদ্ধার করতে পেরেছেন? জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, মাইলর্ড আমরা এখনো টাকা উদ্ধার করতে পারিনি। এ বিষয়ে অফিশিয়ালি চেষ্টা চলছে।

তখন আদালত পাল্টা প্রশ্ন করেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় হাজার হাজার কোটি টাকা উদ্ধার করেছেন, মানুষকে ধরে নিয়ে এসেছেন। এখন দুদক পারে না কেন? দুদকের মধ্যে কারা কারা সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত? জবাবে খুরশিদ আলম খান বলেন, ওই সময় ধরেছি মাইলর্ড। তবে এখন লজিস্টিক  সাপোর্ট নেই।

আদালত তখন বলেন, আপনারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন? ঋণ জালিয়াতির সঙ্গে কারা জড়িত, তা যদি অনুসন্ধান করে বের করতে না পারেন, তাহলে তো দুদক পুরোপুরি ব্যর্থ। এ ধরনের অনুসন্ধানের কোনো প্রয়োজন নেই। আদালত জানতে চান, ঋণ জালিয়াতিতে ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি কেন? জাহালমকে আপনারা আবু সালেক সাজিয়ে কারাগারে পাঠাতে পেরেছেন। আসল আসামিদের খুঁজে বের করতে পারেননি। টাকা উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা নিতে পারতেন। তখন দুদকের আইনজীবী একই কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, আমরা অফিশিয়ালি ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছি। আদালতও তখন বলেন, ঋণ জালিয়াতির বিষয়টি ট্রেস (শনাক্ত) করা দরকার। জানা দরকার কারা কারা এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত।

খুরশিদ আলম খান তখন আদালতকে বলেন, বিধি মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিষয়টি দুদকের নলেজে রয়েছে। কোর্ট চাইলে প্রতিনিয়ত আমরা এ বিষয়ে আদালতকে নথি দেব। এ সময় আদালত জানতে চান, দুদকের আইনে এ বিষয়ে কী ব্যবস্থার কথা উল্লেখ আছে? জবাবে দুদকের অইনজীবী বলেন, অনিয়ম, গাফলতি থাকলে দুদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। ডিআইজি মিজানের ঘটনায় দুদক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।

আদালত বলেন, দুদক একটি প্রতিষ্ঠান। দুদকের কিছু ব্যক্তি সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত হয়ে এ ধরনের অনিয়মের কাজ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে আপনারা কী ব্যবস্থা নেবেন? তাদের গাফিলতির বিষয়ে খতিয়ে দেখেছেন?

এ সময় রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আব্দুল্রাহ আল মাহমুদ বাশার বলেন, অবহেলা থাকলে দুদক আইনে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তিনি এ সময় আরো উল্লেখ করেন, গণম্যাধ্যমে যদি জাহালম নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত না হতো, তাহলে জাহালমকে ভুলবশত জেলেই থাকতে হতো।

আদালতও তার বক্তব্যে একমত পোষণ করে বলেন, সংবাদ প্রকাশিত না হলে জাহালমকে দণ্ড দিয়ে সারাজীবন জেলে রাখা হতো। দুদক বিষয়টি জানার পরও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তারা আরেকটি জজ মিয়া নাটক সাজিয়েছে।

তখন আদালতে উপস্থিত ব্র্যাক ব্যাংকের আইনজীবী আসাদুজ্জামান বলেন, আমরাই প্রথম জাহালমকে শনাক্ত করি। দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা চাপ দিয়ে জাহালমকে আবু সালেক হিসেবে উল্লেখ করতে বাধ্য করেন। বিষয়টি দুদকের দেওয়া প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে।

এ সময় আদালত আইনজীবী আসাদুজ্জামানের কাছে জানতে চান, ব্র্যাক ব্যাংক তাদের যেসব কর্মকর্তা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে? তারা কী এখনো চাকরিতে আছেন? জবাবে আসাদুজ্জামান বলেন, তারা এখনো চাকরিতে বহাল আছেন। তবে তাদের মধ্যে একজন অবসরে গেছেন।

আদালত তখন বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তা এবং দুদকের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এ ঘটনা ঘটেছে। তাদের খুঁজে বের করতে হবে। একটি লোকের ব্যাংকে ১৭টি অ্যাকাউন্ট হয় কীভাবে? এ বিষয়টি কি ব্যাংক কর্মকর্তারা দেখেননি? আমরা একটি অ্যাকাউন্ট করতে গেলে শত রকমের কাগজপত্র জমা দিতে হয়। অথচ এক ব্যক্তির ১৭টি অ্যাকাউন্ট কীভাবে হয়-এটা কেউ খতিয়ে দেখল না?

এ সময় দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, এ ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তা মঈনুল হক দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের ভুল পথে পরিচালিত করেছেন। তিনিই  ঘটনার মূল নায়ক। এ পর্যায়ে আদালত জানতে চান, ওই কর্মকর্তা কি এখনো চাকরিতে আছেন? জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, তিনি এখনো আছেন। তখন আদালত বলেন, আপনারা (দুদক) জাহালমের ঘটনায় দোষ স্বীকার করে নিয়েছে এবং বিস্তারিত তুলে ধরে ভালো একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।

দুদকের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান তখন বলেন, মাইলর্ড আমরা এই প্রথম আদালতের কাছে একটি প্রশংসা পেলাম। যেখানে যাই সেখানেই দুদকের দুর্নাম আর দুর্নাম। এ সময় আদালত বলেন, আমরা চাই শুধু দুর্নাম নয়, দুদকের সুগন্ধও বের হোক! আপনারা সুগন্ধি ছড়ান।

এরপর আদালতের সময় শেষ হয়ে যাওয়ায় আদালত এ মামলার পরবর্তী শুনানি আগামী ২১ আগস্ট দিন ধার্য করেন। জাহালমের ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক কী ব্যবস্থা নেবে, তা হাইকোর্ট দেখতে চান উল্লেখ করে আদালত বলেন, প্রতিবেদনে যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে দুদক কী বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়, আমরা সেটা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম। আমরা এখন ক্ষতিপূরণের রুলের দিকে যাব। আদালত আরো বলেন, প্রতিবেদনে যাদের নাম আসছে (দুদক ও ব্যাংক কর্মকর্তা) তারা যেন টাকা উত্তোলন করতে না পারেন, বিশেষ করে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা সেদিকে নজরে রাখবেন।

এ সময় সোনালী ব্যাংকের আইনজীবী জাকির হোসেন আদালতকে বলেন, সোনালী ব্যাংক তাদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। তখন আদালত বলেন, আপনারা কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা প্রতিবেদন আকারে জমা দিন।

২৬ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিনাদোষে কারাগারে রাখার ঘটনায় কে বা কারা দায়ী, তা দেখার জন্য গত ১৭ এপ্রিল দুদকের কাছে প্রতিবেদন চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। সে অনুযায়ী দুদকের পরিচালক (লিগ্যাল) এবং দুদকের এ ঘটনার তদন্ত কমিটির প্রধান আবুল হাসনাত মো. আব্দুল ওয়াদুদের দেওয়া প্রতিবেদন গত ১২ জুলাই আদালতে দাখিল করা হয়। ওই প্রতিবেদনে আবুল হাসনাত মো. আব্দুল ওয়াদুদ উল্লেখ করেছিলেন,‘সার্বিক বিবেচনায় আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, জাহালমকে আবু সালেকরূপে চিহ্নিত করার যে ভুলটি হয়েছে তা দুদকের তদন্ত কর্মকর্তাদের কারণেই ঘটেছে। তাদের ভুল পথে চালিত করতে সহায়তা করেছে ব্র্যাক ও অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তারা। তবে সঠিক ঘটনা তথা সত্য উদঘাটন করে আদালতের কাছে তা উপস্থাপন করাই ছিল তদন্ত কর্মকর্তাদের দায়িত্ব।’  

গত জানুয়ারিতে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘৩৩ মামলায় ভুল আসামি জেলে’ ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না…’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, আবু সালেকের (মূল অপরাধী) বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির ৩৩টি মামলা হয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের বদলে জেল খাটছেন জাহালম। তিনি পেশায় পাটকল শ্রমিক।

ওই প্রতিবেদনটি আদালতের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত।  আদালত তখন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ আদেশ দেন। গত ৪ ফেব্রুয়ারি জাহালম কারাগার থেকে মুক্তি পান।

মূলত দুদকের একটি চিঠির মাধ্যমে ঘটনার শুরু। জাহালমের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঠিকানায় দুদকের একটি চিঠি যায়। সেই চিঠিতে ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় জাহালমকে হাজির হতে বলে দুদক। জাহালম তখন নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

দুদকের ওই চিঠিতে বলা হয়, ভুয়া ভাউচার তৈরি করে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি ৪৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত আবু সালেক নামের এক লোক, যার সোনালী ব্যাংকের ক্যান্টনমেন্ট শাখায় হিসাব রয়েছে। কিন্তু আবু সালেকের ১০টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের ভুয়া ঠিকানাগুলোর একটিতেও জাহালমের গ্রামের বাড়ির কথা নেই, রয়েছে পাশের আরেকটি গ্রামের একটি ভুয়া ঠিকানা। আর এটিই কাল হয়ে দাঁড়ায় জাহালমের জীবনে। নির্ধারিত দিনে জাহালম তার ভাইকে নিয়ে হাজির হন ঢাকায় দুদকের প্রধান  কার্যালয়ে। তখন জাহালম বুকে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’

দুদকে হাজিরা দেওয়ার পর জাহালম চলে যান নরসিংদীর জুট মিলে তাঁর কর্মস্থলে। এর দুই বছর পর টাঙ্গাইলের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে জাহালমের খোঁজ করতে থাকে পুলিশ। সেখান না পেয়ে ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর ঘোড়াশালের মিল থেকে জাহালমকে আটক করা হয়।

আর তখন জাহালম জানতে পারেন, তাঁর নামে দুদক ৩৩টি মামলা করেছে। ২৬টিতে অভিযোগপত্র দিয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে, তিনি অনেক বড় অপরাধী। পুলিশের কাছেও জাহালম একই কথা বলেন, ‘স্যার, আমি জাহালম। আবু সালেক না। আমি নির্দোষ।’ তখন কেউ শোনেনি তাঁর আকুতি। তাঁকে পাঠানো হয় কারাগারে।

এরই মধ্যে কারাগারে কেটে যায় আরো দুটি বছর। জাহালমকে যতবার আদালতে হাজির করা হয়, ততবারই তিনি বলেন, ‘আমি জাহালম। আমার বাবার নাম ইউসুফ আলী। মা মনোয়ারা বেগম। বাড়ি ধুবড়িয়া গ্রাম, সাকিন নাগরপুর ইউনিয়ন, জেলা টাঙ্গাইল। আমি আবু সালেক না।’

এদিকে জাহালমের ভাই শাহানূর দিনের পর দিন আদালতের বারান্দায় ঘুরতে থাকেন। হাজতখানার পুলিশ থেকে শুরু করে আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারী যাকে পান, তাকেই জাহালম বলতে থাকেন, ‘আমার ভাই নির্দোষ।’ অথচ ব্যাংক, দুদক, পুলিশ সবার কাছেই জাহালম হলেন, ‘আবু সালেক’ নামের ধুরন্ধর এক ব্যাংক জালিয়াতিকারী।